প্রতীকী ছবি।
আজ দেশের ৫৩তম ইঞ্জিনিয়ার দিবস।কারিগরি ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রের প্রবাদপুরুষ স্যর এম বিশ্বেশ্বরাইয়ার জন্মদিন ১৫ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ডে পালিত হয়। ১৬০ বছর আগে, ১৮৬১ সালে কর্নাটকের এক প্রত্যন্ত জেলায় এম বিশ্বেশ্বরাইয়া জন্ম নিয়েছিলেন। শুধু পুথিগত বিদ্যাই নয়, অর্জিত জ্ঞান হাতে কলেমে প্রয়োগ করেছেন পুণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রথম হওয়া ছাত্র। ১৯১২ সালে তিনি তৎকালীন মহীশুরের দেওয়ানের দায়িত্ব নেওয়ার পরেই মাত্র ছ’বছরে কর্নাটকের কারিগরি ও প্রযুক্তি শিল্পে বিরাট পট পরিবর্তন ঘটে যায়। এই সময়ে ব্রিটিশ শাসিত ভারত বহু বার দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে। পর্যাপ্ত জল সরবরাহ না থাকার জন্যই এটা হত। এ ছাড়াও বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থা না থাকায়, প্রতি বছরই বন্যার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হত লক্ষ লক্ষ মানুষকে। সাধারণের এই কষ্ট তরুণ ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বেশ্বরাইয়াকে ব্যথিত করেছিল। তাঁর মনকে গভীর ভাবে নাড়া দিয়েছিল। সমস্যার সমাধান করতে নিরলস পরিশ্রম করেন তিনি। এর ফলে তাঁর আবিষ্কৃত প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি হয় এশিয়ার প্রথম জল সরবরাহ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের রূপরেখা। ১৯০৩ সালে বিশ্বেশ্বরাইয়ার উদ্যোগেই পুণেতে বন্যার জল নিয়ন্ত্রণের উপযোগী অটোমেটিক ফ্লাড বোট বসানো সম্ভব হয়েছিল। শুরু হয়েছিল সেচ ব্যবস্থাও। শুধু তাই নয়, এশিয়ার সর্ববৃহৎ জল সরবরাহ কেন্দ্রটিরও প্রযুক্তিগত কারিগর ছিলেন স্যার এম বিশ্বেশ্বরাইয়া। হায়দরাবাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা মহীশুরের রাজা কৃষ্ণসাগর বাঁধ নির্মাণেরও মূল স্থপতি ছিলেন এম ভি। এ সবের জন্যই রাজা পঞ্চম জর্জের আমলে ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে বিশ্বেশ্বরাইয়াকে নাইট উপাধিও দেওয়া হয়। ১৯৫৫ সালে তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারতরত্নে ভূষিত করা হয়। ১৯১৭ সালে তিনি বেঙ্গালুরুতে দেশের পঞ্চম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গোড়াপত্তন করেন। যা আজ বিশ্বেশ্বরাইয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসেবে সুপরিচিত। দেশের কৃষি প্রযুক্তিতেও তার অবদান রয়েছে। এমন এক মানুষকে সম্মান জানাতেই ১৯৬২ সাল থেকে সারা দেশে তাঁর জন্মদিন, ১৫ সেপ্টেম্বরকে ইঞ্জিনিয়ার্স ডে হিসেবে পালন করা হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাড়াও বেঙ্গালুরুতে পলিটেকনিক কলেজও তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের প্রথম কৃতী ইঞ্জিনিয়ারের জীবনাবসান হয় ১০১ বছর বয়সে ১৯৬২ সালের ১৪ এপ্রিল বেঙ্গালুরুতেই।
একজন ভাল ছাত্র যে সর্বগুণসম্পন্ন হতে পারেন সে প্রমাণও রেখেছেন স্যার বিশ্বেশ্বরাইয়া। যেমন কর্নাটকের ও হায়দরাবাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, ব্যাঙ্কিং পরিষেবা, শিক্ষা ব্যবস্থাতেও তাঁর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। বলা যেতে পারে, কর্নাটক যে দেশের প্রযুক্তি শিল্পের প্রধান কেন্দ্র বলে আজ পরিচিত, হাইটেক সিটি হিসেবে বিশ্ববন্দিত, তার প্রথম দিশা দেখিয়েছিলেন স্যর বিশ্বেশ্বরাইয়া।
ইঞ্জিনিয়ারিং দিবসে প্রতি বছরই একটি নতুন থিমের মাধ্যমে পালন করা হয়। উল্লেখ্য, কারিগরি ও প্রযুক্তির প্রণয়নে দেশ ও জাতির ঠিক কতটা অগ্রগতি হল এবং তাতে দেশের ইঞ্জিনিয়ারদের ভূমিকা ঠিক কতটা, তা তরুণ প্রজন্মের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তবিদদের কাছে তুলে ধরার জন্যই এই দিবস পালন করা হয়। যেমন ২০১৮ সালে থিম ছিল ‘ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন নিউ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন’। শিল্প জগতের চতুর্থ বিপ্লব যা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ হিসেবে জনপ্রিয়, সেটাকে সামনে রেখেই তৈরি হয়েছিল এই থিম। সাইবার ফিজিক্যাল ব্যবস্থা ঢুকে পড়েছে এই পর্যায়ে। চলে এসেছে ক্লাউড ভিত্তিক উৎপাদন ও শিল্প পরিষেবা ব্যবস্থা। এসেছে বিগ ডেটা, ইন্টারনেট অফ থিংস, সাইবার সিকিউরিটি, মেশিন লার্নিং, আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সের মতো বিষয়। যা শিল্পবিপ্লবের তৃতীয় স্তর টেলি কমিউনিকেশন, নেটওয়ার্কিং, তথ্য প্রযুক্তির থেকেও আরও এগিয়ে, আরও জটিল। স্বাস্থ্য-প্রযুক্তি যেখানে হাত মেলাচ্ছে তথ্য-প্রযুক্তিতে। রোবোটিকসের প্রাধান্য বাড়ছে। উৎপাদন ব্যবস্থা ক্রমশই হয়ে যাচ্ছে কম্পিউটার বিজ্ঞান নির্ভর। এমনকি অচিরেই কৃষি-শিল্পেও জায়গা করে নিতে চলেছে উৎপাদনমুখী অতি আধুনিক প্রযুক্তি।
আরও পড়ুন: ঘরের পথে মৃত্যু কত, জানে না কেন্দ্র
২০১৯ সালে থিমের পরিবর্তন হয়। আসে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ফর চেঞ্জ’। যেহেতু গ্লোবাল ওয়ার্মিং এখন প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীদের কাছে অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় সেদিকে তাকিয়েই এই থিম বাছা হয়। তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অতি দ্রুত প্রসার হচ্ছে। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং যেখানে সারথি। পৃথিবী জুড়ে তৈরি হচ্ছে স্মার্ট সিটি আর স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা। স্বাভাবিক ভাবেই যন্ত্রজালে সাংঘাতিকভাবে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। প্রযুক্তিবিদদের এখন এগুলিকে সামলাতেই বেশি মনোযোগী হতে হবে। এটাই ছিল ২০১৯ সালের ইঞ্জিনিয়ার দিবসের আহ্বান। আবার একমুখী ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবস্থা ভেঙে তৈরি হচ্ছে মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি কারিগরি ও শিক্ষাব্যবস্থা। ইনোভেশন, ডিসরাপটিভ টেকনোলজি, সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট এবং রিনিউএবল এনার্জি প্রাধান্য পাচ্ছে প্রযুক্তিবিদদের আলোচনায়। প্রথাগত শক্তির বদলে চলে এসেছে সোলার এনার্জি বা উইন্ড এনার্জি। এমনকি গণপরিবহণ ব্যবস্থাকে কী ভাবে সবুজ পরিবহণ ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করা যায় তা নিয়ে উদ্যোগী হয়েছেন ইঞ্জিনিয়াররা।
এই বছরের ইঞ্জিনিয়ার্স ডে কিন্তু এসেছে নতুন বার্তা নিয়ে।এ বারের ইঞ্জিনিয়ার্স ডে-র থিম হল ‘ইঞ্জিনিয়ার্স ফর সেলফ রিলায়েন্স ইন্ডিয়া’। কোভিড-১৯ এর অতিমারিতে যখন আক্রান্ত দেশ তথা বিশ্ব। বিপর্যস্ত অর্থনীতি। উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্বও প্রকট। এই অবস্থাতেও স্বাস্থ্য পরিষেবা কর্মী, প্রশাসন, সরকার প্রত্যেকেই মরিয়া চেষ্টা করছে সাধারণ নাগরিকদের সুস্থ রাখার, সমর্থ রাখার। তাঁদের মনোবলকে চাঙ্গা রাখার। এতেও প্রযুক্তবিদদের দরকার। দায়িত্ব নিচ্ছেন ফার্মাসিস্ট, বায়োটেকনোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট বা বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা। শূন্য থেকে শুরু হলেও এখন দিনে আমাদের দেশ তৈরি করছে ২ লক্ষেরও বেশি পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) কিট, ১০ লক্ষেরও বেশি স্বাস্থ্যবিধিসম্মত মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা গ্লাভস। বাড়ছে সেন্সর টেকনোলজির ব্যবহারও। কোভিড ১৯ অতিমারিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এ সবই এখন অতি প্রয়োজনীয়। ঠিক ভাবে এই সব প্রযুক্তি উৎপাদন বাড়াতে পারলে সারা পৃথিবীতে অদূর ভবিষ্যতে আমরাই ডিজিটাল লিডারশিপ দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে পারি। তাই ইঞ্জিনিয়ারদের কদর কোনও দিনই কমবে না।
(লেখক জেআইএস গ্রুপের জিএম, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy