বছর পঞ্চান্নর দুলারি দেবীর কাছে এই শনিবারটা অন্য শনিবারের মতো নয়। এই শনিবার তাঁর হাতে আঁকা মধুবনি নকশার শাড়ি পরে সংসদে বাজেট পেশ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন!
নির্মলা বাজেট পেশ করেছেন সাদা বেঙ্গালুরু সিল্কের শাড়ি পরে। সেই শাড়ির দু’প্রান্তে বিহারের বিখ্যাত মধুবনি শিল্পের ছোঁয়া। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর পদে বৃত হওয়ার পর থেকেই বাজেট পেশের দিনটিতে নির্মলার পরিধেয় নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। শনিবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। নির্মলার বাজেটের পাশাপাশি অতএব, আলোচনা হয়েছে তাঁর পরনের শাড়িটি নিয়েও।
জোড়া মাছের কল্কা আঁকা শাড়িটি তৈরি করেছেন মধুবনি শিল্পী দুলারি। নির্মলা বাজেট পেশ করার পর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। দুলারি জানিয়েছেন, এক মাস ধরে শাড়ির ওই নকশা এঁকেছেন তিনি। কখনও কখনও ভোর চারটের সময়েও কাজে বসতে হয়েছে। ‘মিথিলা আর্ট ইনস্টিটিউট’ (যা ‘মিথিলা চিত্রকলা সংস্থান’ বলে পরিচিত)-এর এক অনুষ্ঠানে মধুবনিতে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় দুলারির। আনন্দবাজার অনলাইনকে দুলারি বলেন, “সীতারামন যখন এখানে এসেছিলেন, তখন মিথিলা চিত্রকলা সংস্থান থেকে শাড়িটি তাঁকে উপহার দেওয়া হয়। শাড়িটির দু’প্রান্তে জোড়া মাছের কল্কা আঁকা ছিল। মাছ বিষ্ণুর অবতার। সেটিই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শাড়িটিতে। সেটিতে পদ্মফুলও ছিল। সীতারামন সেই উপহার দেওয়া শাড়িটা পরেছেন দেখে আমি খুব খুশি।” তাঁর মতে, এটি মধুবনির মানুষ আর মধুবনি চিত্রকলার জয়।
মধুবনি চিত্রকলায় তাঁর অবদানের জন্য ২০২১ সালে ‘পদ্মশ্রী’ পান দুলারি। মধুবনি শিল্পকলার জন্য অতীতে অন্য অনেক সম্মান এবং পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। কিন্তু শনিবারের প্রাপ্তি তাঁর মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে বলে জানাচ্ছেন দুলারি। মৎস্যজীবী পরিবার থেকে উঠে আসা দুলারি মধুবনি চিত্রকলাকে নবীন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ১০ হাজারেরও বেশি ছবি এঁকেছেন তিনি। ৫০টিরও বেশি প্রদর্শনীতে তা স্থান পেয়েছে। ইতিমধ্যেই হাজারের বেশি পড়ুয়াকে মধুবনি চিত্রকলায় প্রশিক্ষিত করে তুলেছেন তিনি। কিন্তু সেখানেই থামতে চান না। মধুবনি চিত্রকলাকে আরও প্রচারের আলোয় নিয়ে আসতে চান। তবে মনে করেন, এটা তাঁর একার চেষ্টা নয়। অনেকের মিলিত চেষ্টা।
আরও পড়ুন:
রামায়ণের কাহিনিতে মিথিলার বিবরণ পাওয়া যায়। মহাকাব্যের কাহিনি অনুযায়ী, মিথিলাতেই জন্ম সীতার। শনিবার খানিকটা আবেগতাড়িত গলাতেই দুলারি জানালেন, সীতাকে মিথিলাবাসী যে ভাবে বিদায় জানিয়েছিলেন, তেমনই নির্মলা মিথিলা ছাড়ার সময়েই তাঁকে ওই শাড়িটি উপহার দেওয়া হয়েছিল। পদ্মসম্মানে ভূষিত দুলারি আপাতত একটি কলেজে নবীন প্রজন্মকে মধুবনি চিত্রকলা শেখান। এই নকশার প্রতি তাঁর অমোঘ টান। মধুবনি চিত্রকলাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। বিভিন্ন জিনিসের উপর নকশার কাজ করেন। সব সময় শাড়ি বানানোর সময় পান না। তার উপর কলেজে নতুনদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও থাকে। সেই সমস্ত কাজের ফাঁকে ফাঁকেই শাড়িটি তৈরি করেছিলেন তিনি। এক মাস সময় লেগেছিল নির্মলার পরনের শাড়িটি বানাতে। রবিবার ছুটির দিনে বা কখনও-সখনও সপ্তাহের কাজের দিনেও ভোর চারটের সময়ে ঘুম থেকে উঠে শাড়িটির নকশা আঁকতেন তিনি।
তবে সেই শাড়িটিই যে নির্মলাকে উপহার দেওয়া হবে, তা জানতেন না দুলারি। নিজের শখেই শাড়িটি এঁকেছিলেন। খানিকটা আনন্দিত বিস্ময় নিয়েই দেখেন, নির্মলাকে তাঁর তৈরি শাড়ি উপহার দেওয়া হয়েছে। ঘটনাচক্রে, এর আগেও অনেককে অনেক মধুবনি চিত্রকলা সংবলিত শাড়ি উপহার দিয়েছেন দুলারি। তবে সেগুলি কেউ পরেছেন কি না, তা জানা নেই তাঁর। দুলারির কথায়, “আগেও তো অনেককে উপহার দিয়েছি। সেগুলো নিশ্চয়ই তাঁরা পরেওছেন। তবে আমার বা অন্য কারও চোখে পড়েনি। সীতারামনই প্রথম, যাঁকে আমার আঁকা উপহার দেওয়া শাড়ি পরতে দেখলাম।”
দুলারি দেখলেন। দেখল সারা দেশ। লোকমুখে আরও এক বার ছড়িয়ে গেল মধুবনি চিত্রকলার কথা। যেমন চেয়েছেন, চান এবং চাইবেন দুলারি।