Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

দেনার দায়ে বিক্রি চাষির ‘আম্মা’

পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ৪৫% খরার কবলে। ঋণের দায়ে আত্মহত্যা ছাড়া পথ নেই কৃষকের। বাঁচার রাস্তা?পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ৪৫% খরার কবলে। ঋণের দায়ে আত্মহত্যা ছাড়া পথ নেই কৃষকের। বাঁচার রাস্তা?

জয়াম্মা। নিজস্ব চিত্র

জয়াম্মা। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস ঘড়াই
অনন্তপুর (অন্ধ্রপ্রদেশ) শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৯ ০১:১৯
Share: Save:

মাথায় গামছা। কোলে তিন বছরের ছোট ছেলে। তাকে নিয়েই মাঠে গিয়েছিলেন জয়াম্মা। যেতেই হয়। না হলে সংসারটা চলবে কী ভাবে! যার যাওয়ার কথা ছিল, সে তো টুক করে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। নাহ্, জয়াম্মা আর ভাববেন না সে-সব কথা। কিন্তু গ্রামের খাঁ-খাঁ, ধূ-ধূ মাঠটার সামনে দাঁড়ালে তো শুধু লোকটার কথাই মনে পড়ে। আর কান্না পায়। ‘‘জানেন, ওর কীটনাশকের গন্ধটাই পছন্দ হত না। কী করে তা হলে মুখে পুরল? যে দিন মুখে পুরেছিল, তার কয়েক দিন আগে থেকে শুধু বলত, এত ধার, এত ধার। মুখ দেখাব কী করে!’’ কাঁদছেন আর বলছেন জয়াম্মা। কত ধার ছিল? ১৬ লক্ষ টাকা!

আকাশে মেঘ নেই, মাটিতে ফসল নেই। শুধু খরা আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে অনন্তপুরের গুত্তি মণ্ডলের বাচুপল্লি গ্রামকে। ধার মিটবে কীসে! শেষ পর্যন্ত মুখ লুকোতে গিয়ে গত বছর মুখের ভিতর কীটনাশকই ঢেলে নিয়েছিলেন জয়াম্মার স্বামী কৃষক ডক্কা শঙ্করাইয়া। ছ-ছ’টা ছেলেমেয়ে। বড় মেয়েটার বয়স পনেরো বছর। একদম ছোটটা কোলে, তিন বছরের। নিজের স্বামীর উপরে অভিমান যায় না জয়াম্মার। রোগা, ক্ষীণ শরীরটা কান্নার সঙ্গে দুলতে থাকে। জয়াম্মার নিজেরই চারবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়েছে। ক্যান্সার? ‘‘কী জানি!’’, মুখ উল্টে জবাব দেন জয়াম্মা। একবার করে অস্ত্রোপচার হচ্ছে, আর জীবনশক্তি কমে যাচ্ছে যেন। কিন্তু নিজের শরীরের দিকে তাকানোর ফুরসত কোথায়। তা হলে ওই পাষাণ-মাঠটার সঙ্গে কে লড়বে? জয়াম্মা বলতে থাকেন, ‘‘খরা আমার সবটুকু কেড়ে নিল। কিন্তু আমিও ছাড়ব না। আরও পাঁচ একর জমি লিজ নিয়েছি। চাষ আমি করবই।’’ ধারের জন্য যে সমস্ত চুক্তিপত্র হয়েছিল শঙ্করাইয়ার সঙ্গে অন্যদের, সেগুলো পাগলের মতো হঠাৎ দেখাতে থাকেন জয়াম্মা। চুক্তিপত্রের শেষ পাতায় শঙ্করাইয়ার আঙুলের ছাপ। সে ছাপের উপরে এসে থমকে যায় জয়াম্মার আঙুল। আঙুলের ছাপের উপরে আঙুল বোলাতে থাকেন জয়াম্মা।

পাশে বসা দশ বছরের মেয়ে কবিতা জয়াম্মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘বাবা বেঁচে থাকার সময় মা কখনও মাঠে যায়নি। মা-ই এখন চাষ করে। আমি বাড়ি সামলাই। ভাইবোনেদের দেখি।’’ দশ বছরে বাড়ি সামলানো? প্রাপ্তবয়স্কের মতো মাথা নাড়ে কবিতা।

খরার দেশে বাচ্চারা দ্রুত বড় হয়ে যায়। হতেই হয়! সমস্ত কিছুর মতোই খরার কাছে শৈশবের বিলাসিতার যে কোনও মূল্য নেই। শুধু রোদের তাপে ঝলসে যাওয়া আছে, কাঠফাটা ধূ-ধূ প্রান্তর রয়েছে। আর রয়েছে শঙ্কারাইয়ার মতো চাষিদের হাহাকার!

যে কীটনাশক চাষের জন্য ব্যবহার করার কথা, সেই কীটনাশকই চাষিরা নিজেদের জীবন শেষের জন্য বেছে নিচ্ছেন! গত মাসেই কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন বাচুপল্লি গ্রামেরই আরেক কৃষক আম্মাত্তি রামকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণের স্ত্রী লক্ষ্মী বলছেন, ‘‘ওঁর মৃত্যুর পর জানলাম চাষের জন্য সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ধার রয়েছে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কিচ্ছু জানতে পারিনি।’’ রামকৃষ্ণের ভাই নরসিংহুলু বলছেন, ‘‘আত্মহত্যার মিছিল শুরু হয়েছে এখানে!’’

মিছিলই বটে! এক বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা জানাচ্ছে, ২০১৪-২০১৯ সালের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের সবথেকে বড় এই অনন্তপুর জেলায় ৫২২জন কৃষক শুধু খরার কারণে আত্মহত্যা করেছেন! এখানকার প্রায় ৬৫ শতাংশ জমিই খরার গ্রাসে গিয়েছে। অনন্তপুরের খরা নিয়ে কাজ করছেন ওয়াই ভি মাল্লারেড্ডি। মাল্লারেড্ডি বলছেন, ‘‘অনন্তপুরের ৬৩টি মণ্ডলই খরা-কবলিত। গত বছর থেকে চাষিরা এখনও পর্যন্ত কোনও বীজ লাগাতে পারেননি! একটা
বীজও না!’’

বৃষ্টি নেই। খরার গ্রাসে চলে গিয়েছে জমি। রামরাজুপল্লির আদি নারায়ণ রেড্ডিকে তাই জমি বিক্রি করে দিতে বলেছিলেন ছেলে অনন্তভেঙ্কট। অনন্তভেঙ্কট বলছেন, ‘‘বাবাকে বলেছিলাম চিন্তা করো না। জমিটা বিক্রি করে দেনা মিটিয়ে দিই। বাবা শুধু বলেছিল, জমি চলে গেলে মুখ দেখাব কী করে! জমি তো আম্মা (মা)!’’ দেনায় ‘আম্মা’কে হারিয়ে ফেলার ভয়ে শেষ পর্যন্ত আদি নারায়ণ আত্মহত্যা করেন গত জানুয়ারিতে। চাষিদের নিয়ে কাজ করা শ্রীষিমা বলছেন, ‘‘জমি চাষিদের কাছে মা, তাঁদের সম্মান। মা’কে বিক্রি করে দিতে হবে, এটা ভাবতে পারেন না তাঁরা। সম্মান হারানোর ভয়ে আত্মহত্যা করছেন তাঁরা। আমরা গ্রামে ঘুরে-ঘুরে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা প্রচারের চেষ্টা করছি।’’

চেষ্টা চলছে ঠিকই। কিন্তু ‘মা’ মুখ ঘুরিয়ে নিলে সে চেষ্টার আর কতটুকুই বা দাম! খরাদীর্ণ জমি চাষিকে ফিরিয়ে দিচ্ছে রোজ। কোলে তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে খালি হাতে রোজ মাঠ থেকে ঘরে ফিরে আসেন জয়াম্মাও। ছোট ছেলেমেয়েগুলোর কী হবে, ভাবতে-ভাবতে কাঁদতে থাকেন অঝোরে!

অনন্তপুরের কোনও গ্রামে একফোঁটা বৃষ্টি নেই। যত জল শুধু জয়াম্মার চোখে!

অন্য বিষয়গুলি:

Andhra Pradesh Drought
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy