অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ
মোতেরাতে ‘নমস্তে ট্রাম্প’? বেশ।
এখন তো নির্জোট আন্দোলন প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। একমেরু বিশ্বে ভারত আবার কবে জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসনের চান্স পাবে, জানা নেই। শুধু এটুকু জানা আছে যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের খুব ভাল বন্ধু। সেই জন্য একটি অসরকারি সংস্থা ট্রাম্পকে সংবর্ধনা দিচ্ছে এবং সেই খাতে গুজরাট সরকার খরচ করতে চলেছে আনুমানিক একশো কুড়ি কোটি টাকা।
আমরা জানি সরকারের তহবিলে যে করের টাকা আসে তা কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ কর নয়, পরোক্ষ নানা করের থেকেও জোগান আসে। মূলত জিএসটি বাবদ যে কর সংগ্রহ হয় তা-ই কেন্দ্র ও রাজ্যের মূল আয়। এই জিএসটি মেটাই কিন্তু আমরা সবাই। অর্থাৎ শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ কর প্রদানকারী সাদা কলারের চাকরি করা মানুষই নয়, সমস্ত উপভোক্তাই এর আওতাধীন। তো ট্রাম্প যখন আসবেন, পথ দিয়ে মোদীর সাথে ব্যতিক্রমী রোড শো করবেন, তখন ভারতীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তির পুরোটাই দৃষ্টিগোচর হবে তো?
কথাটা এইজন্য বলা যে— এটা হীরকরাজার দেশ নয় আর ব্যক্তিগত মালিকানায় সরকার চলে না। সরকারের অর্থনীতি সাধারণ মানুষের যোগদান ব্যতিরেকে মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু, আহা, না হয় ধরেই নিলাম যে না করে উপায় নেই, তবুও যাদের টাকা আর পরিশ্রমে সরকার চলে আর যারা কি না এত দূর বেটি বাঁচাচ্ছে আর বেটি পড়াচ্ছে, কখনও সেই বেটিদের একাংশকে ঋতুচক্র চলছে কিনা তার প্রমাণ রাখতে অন্তর্বাস খুলতে বাধ্য করা হচ্ছে, কখনও বা শোনা যাচ্ছে সতীত্ব পরীক্ষার জন্য প্রাগৈতিহাসিক প্রণালীর অন্তর্ভুক্ত হতে হচ্ছে। আর এ সবই হচ্ছে গুজরাট নামক রাজ্যটিতে, যার অস্মিতার লেভেল এখন উচ্চতায় চার ফিট আর বহরে প্রায় বারো কিলোমিটার।
আরও পড়ুন: ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কি? সফরে মোদীর কাছে জানতে চাইবেন ট্রাম্প
ট্রাম্প যাবেন, গুজরাতে এ ভাবেই রাস্তার পাশের বস্তি ঢাকা হচ্ছে পাঁচিলে। ছবি: পিটিআই।
হ্যাঁ, অস্মিতাই বটে। বাছাই করা মানুষেরা থাকবেন রাস্তার দু’ধারে আর স্টেডিয়ামে। পুরো অনুষ্ঠান চালাবে একটি অসরকারি সংস্থা। টাকা ঢালবে রাজ্য সরকার। শুধুমাত্র আমদাবাদের যে বারো কিলোমিটার রাস্তা দিয়ে এই মহাজাগতিক রোড শো হবে তার পাশের বস্তিগুলি চার ফিট উঁচু পাঁচিলে ঢাকা পড়ে যাবে। ট্রাম্প বা তাঁর সফরসঙ্গীরা সে সব দেখতে পাবেন না।
অবধারিত ভাবেই আমাদের ‘হীরক রাজার দেশ’-এর সেই দৃশ্যগুলো মনে পড়ে যায়, যেখানে দারিদ্রের চিহ্নটুকু মুছে দেওয়া প্রয়োজন ছিল বর্ষাপূর্তি উৎসবের জন্য। বাঘা বাইনের ভাষায় যা আসলে ভরসা পূর্তি, তা ভাল ভাবে করতে গেলে তো এমনটা করতেই হবে। না হলে, রাজা রাজড়াদের ভরসা আসবে কোথা থেকে? কিন্তু গণতন্ত্র তো তা নয়। সেখানে জনসাধারণের অর্থে চলা একটি সরকার কী ভাবে তথাকথিত মূলস্রোতের চকচকে উন্নয়ন শানিত যাত্রাপথে অগণিত জনসাধারণকে প্রান্তিক করে রাখতে পারে? এটা ন্যায়!
অবশ্য দিনকাল যা তাতে ‘শ্যামা’র বজ্রসেনের মতো প্রধানমন্ত্রী বলতেই পারেন, ‘ন্যায় অন্যায় জানিনে, জানিনে, জানিনে, শুধু তোমারে জানি’, ‘ওগো সুন্দরী’র জায়গায় ‘ওগো ব্যাপারী’। ট্রাম্প তো শিখিয়েছেন কেমন ভাবে যা বাস্তবোচিত নয় তাকেই রাজনৈতিক মূলধন বানিয়ে বিক্রিবাটায় নামতে হয়। মেক্সিকোর অভিবাসীদের নিয়ে সমস্যা আছেই। জনসাধারণের একাংশ তাই নিয়ে হয়তো বা উদগ্রীব। কিন্তু সেটাকেই তুমুল ইস্যু বানিয়ে ফেলার মধ্যে যে চাতুর্য আছে তা অভিনব। ২০১৬-র নির্বাচনে ট্রাম্প তাই করলেন। হাতেনাতে ফলও পেলেন।
আরও পড়ুন: উত্তরপ্রদেশে মাটির নীচে ৩ হাজার টন সোনার খোঁজ পেল জিএসআই
আমাদের স্বভাবের মধ্যে যেমন নানা ইতিবাচক দিক আছে তেমনই অন্ধকারও আছে। অতি দক্ষিণপন্থী শক্তি সেই অন্ধকারের উপাদানগুলিকে জল বাতাস জুগিয়ে সতেজ রাখে। গরিব বেকার অভিবাসীরা বেআইনি ভাবে আমাদের সব কাজ নিয়ে নিচ্ছে এবং সেই অবস্থাকে সামাল দেওয়াই প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য— এমন একটি রাজনৈতিক লাইন নিলে অলস মস্তিষ্ক সেই দিকেই খানিকটা চলে যেতে পারে। যদিও তা সাময়িক কিন্তু কিছুটা অবধারিত। এদেশ, ওদেশ বলে নয়। সর্বত্রই। সাথে বলা হল দুই দেশের মধ্যে যে চিরস্থায়ী পাঁচিল তোলার কাজ অসম্পূর্ণ আছে তাকে যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। একেবারে হৈ হৈ করে না এলেও, স্বার্থ রক্ষা রাজনৈতিক কর্তব্য ধরে নিয়ে অনেক ভোট সাময়িক ভাবে এসে যেতে পারে।
কিন্তু দেশটির নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর শাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতি ধাঁচের। অর্থাৎ, শুনতে যতই ক্ষমতাবানের মতো মনে হোক, রাষ্ট্রপতি শাসন কার্যত বহু ভারসাম্য আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়। তিন হাজার একশো পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার গাঁথনি বা ফেন্সিং যাই হোক, তার অর্থ কোথা থেকে আসবে তাই নিয়েই চার বছর ধরে টানাপড়েন চলল। বিভিন্ন আদালত, কমিশন, কমিটি ঘুরে কোনও স্পষ্ট দিশা দেখা যায়নি। সরকারের টাকা যে জনসাধারণের করের অংশ তা সে দেশের সরকারি কাঠামোতে স্বীকৃত। সাধে কি আর নোয়াম চমস্কি বলেন যে বিদেশনীতি যতই সাম্রাজ্যবাদী হোক না কেন, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র বেশ আঁটোসাঁটো। সেখানে সহজেই যে একনায়কতন্ত্রের মাছি গলে যাবে তা হওয়ার নয়। নাগরিক অধিকার সম্পর্কেও মানুষ মোটামুটি এখন সচেতন। মাঝেমধ্যে গুলিয়ে গেলেও, দেশজোড়া অতি দক্ষিণপন্থা খানিক দাপিয়ে ফেললেও, অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা মজুত আছে। এই চার বছরে ট্রাম্প প্রশাসন শুধুমাত্র তেলা মাথায় তেল দিয়েছেন অর্থাৎ যেটুকু পাঁচিল ছিল তাই পোক্ত করেছেন, তাপ্পি লাগিয়েছেন। নতুন করে কাজ বিশেষ এগোয়নি কারণ টাকা কে দেবে, কেনই বা দেবে, দিয়ে কী হবে এইসব নিয়েই সরকারি মহলে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে।
আরও পড়ুন-ভারতে এসে বাণিজ্যে লাভ হবে না, বুঝে গিয়েছেন ট্রাম্প
আমাদের দেশে টাকা গলে যাওয়া বিশেষ সুবিধাজনক। রাজশক্তির ইচ্ছামাফিক। তাতে জনগণের সম্মতি আছে কিনা দেখার প্রয়োজন নেই। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সরকারি নিয়মকানুন না মানলেও চলে। তবে জনগণের অর্থ দিয়ে জনগণকে আড়াল করা এর আগে হয়েছে বলে শুনিনি। ট্রাম্প অলরেডি আমাদের রাজ্যপালের মতো অপমানিত হতে শুরু করেছেন। যথেষ্ট সম্মানের অভাবে বাণিজ্য চুক্তি পিছিয়ে দিয়েছেন। বলছেন ভোটের পর যদি জিতে আসেন তবে জবরদস্ত বাণিজ্য চুক্তি হবে। গাজর আপাতত ঝুলুক। এর পর যদি চার ফিট পাঁচিলের উপরে কোনও বস্তির বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে ট্রাম্প আঙ্কলকে ‘টুকি’ বলে বসে, তা হলে একেবারে ডবল অপমান!!
লেখক পরিচিতি: বঙ্গবাসী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy