নাথুরাম গডসে। —ফাইল চিত্র।
রবিবার মঞ্চে উঠবেন নাথুরাম গডসে! মহাত্মা গান্ধীর ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ মন্ত্রকে খারিজ করে বলবেন, ধর্ম যখন ‘সঙ্কটে’, তখন ধর্মকে বাঁচাতে হিংসাও ‘কর্তব্য’! কেন মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা ‘করতে হল’, তার ব্যাখ্যা দেবেন!
জুহুর সৈকতে তখনও সূর্য সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়নি। জুহু চার্চ রোডের পৃথ্বী থিয়েটারের কাফেতে বিকেলের ভিড়। শশী কপূরের পুত্র কুণাল এখন পৃথ্বী থিয়েটার চালান। তাঁর আয়োজনে বাৎসরিক পৃথ্বী থিয়েটার উৎসব চলছে। একটু আগে নাটক শুরুর থার্ড বেল পড়েছে। মার্কন্ড দেশপাণ্ডের নাটক শুরু হবে। বাইরে ‘হাউসফুল’ বোর্ড। অথচ পৃথ্বী কাফের আড্ডায়, সুলেমানি চায়ের কাপের ধোঁয়ায় অন্য একটি নাটক নিয়ে আলোচনা। রবিবার থেকে মুম্বইয়ে তার অভিনয় শুরু হচ্ছে। নাটকের নাম ‘নাথুরাম গডসে কো মরনা হোগা’।
মহারাষ্ট্রের নির্বাচনের চার দিন আগে এই গুঞ্জন শুনে খোঁজ করতেই হল। হেলাফেলা করার নাটক নয়। বলিউডের পরিচিত মুখ অনন্ত মহাদেবন অভিনয় করবেন। নাথুরাম কেন গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন, সেই যুক্তি সাজিয়ে গোপাল গডসের লেখা ‘শুনুন ধর্মাবতার’ বইয়ের উপরে ভিত্তি করে নাটক তৈরি হয়েছে। পরিচালনায় বলিউডের আর এক পরিচিত মুখ ভারত দাভোলকর।
পৃথ্বী কাফের আড্ডায় জোর বিতর্ক। এক পক্ষের প্রশ্ন, এটাও কি মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার কৌশল? যোগী আদিত্যনাথ মহারাষ্ট্রে নির্বাচনী প্রচারে বলছেন, ‘বাঁটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মহারাষ্ট্রে এসে সেটাই ঘুরিয়ে বললেন, ‘এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়’। এই নির্বাচনের বাজারে হঠাৎ গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে নায়ক সাজিয়ে নাটক কেন? ‘বাঁটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’-র সুরে হিন্দু ভোটের বিভাজন রুখতে হিংসার যুক্তিকে সমর্থন করা? অন্য পক্ষের যুক্তি, তা কেন? অতীতেও ‘মি নাথুরাম গডসে বোলতয়’ নামে মরাঠী নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে।
আদিত্যনাথ মহারাষ্ট্রে হিন্দু ভোটকে ভাগ করার চেষ্টা হলে কেটে ফেলার হুঁশিয়ারি দিয়ে ‘বাঁটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’ স্লোগান তুলেছিলেন। বিজেপির শরিক অজিত পওয়ার বিরক্ত হয়েছিলেন। কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে আসা অশোক চহ্বাণও। বিজেপির দেবেন্দ্র ফডণবীস পাত্তা না দিয়ে বলে দিয়েছেন, হিন্দু বিরোধী মতাদর্শের দল থেকে আসা অজিত পওয়ার, অশোক চহ্বাণের এ সব বুঝতে সময় লাগবে। কিন্তু বিজেপির ‘ঘরের মেয়ে’ পঙ্কজা মুণ্ডেও যোগীর স্লোগানে অসন্তুষ্ট। মোদী মহারাষ্ট্রে প্রচারে গিয়ে প্রথমেই যোগীর কথাকে নরম সুরে বলেছেন, ‘এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়’। হিন্দুরা এককাট্টা থাকলেই নিরাপদ। যুক্তি দিয়েছেন, কংগ্রেস তোষণের রাজনীতি করে। দলিত, আদিবাসী, ওবিসিদের মধ্যে বিভাজন করে। রামমন্দিরের বিরোধিতা করে। গৈরিক সন্ত্রাসের অভিযোগ তোলে। কাশ্মীরে সংবিধান জারি করতে দেয় না। ৩৭০ অনুচ্ছেদ ফেরাতে চায়।
এই প্রচারে আরএসএস-ও পিছিয়ে নেই। লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস নিষ্ক্রিয় ছিল। মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটে আবার আরএসএসের প্রচারকেরা সাতসকালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘একশো শতাংশ ভোট’-এর কথা বলছেন। মুম্বই, পুণে, নাগপুরের মতো শহরে প্রভাবশালী, বিশিষ্টদের প্রতিনিধি নিয়ে আরএসএস ‘দীপাবলি মিলন’-এর আয়োজন করছে। বোঝানো হচ্ছে, মুসলিমরা এককাট্টা হয়ে মহা বিকাশ আঘাড়ীকে ভোট দিচ্ছে। ব্রাহ্মণ, মরাঠা, দলিত, ওবিসি—সহ হিন্দু সমাজকে এককাট্টা হয়ে ভোট দিতে হবে। ‘সকল হিন্দু সমাজ’-এর মতো সংগঠন সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পুণেতে সঙ্ঘ থেকে উঠে আসা বিজেপির প্রবীণ নেতা আনন্দ মালেগাঁওকরের যুক্তি, ‘‘লোকসভা ভোটে মুসলিমদের সঙ্গে দলিতরাও কংগ্রেস তথা আঘাড়ীকে ভোট দিয়েছিল। কারণ, বিজেপি ৪০০ আসনে জিতলে সংবিধান বদলে দেবে বলে দলিতদের মধ্যে ভয় তৈরি হয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতলেও সংবিধান বদলাতে পারবে না। এ কথা এবার দলিতরা বুঝবেন।’’
‘‘মহারাষ্ট্রের ভোটে জিততে বিজেপি মরাঠা, ওবিসি, ব্রাহ্মণ, জাতপাত নির্বিশেষে হিন্দু ভোট এককাট্টা করতে চাইছে। তাই হিন্দু খতরে মে হ্যায় বলে মিথ্যে প্রচার শুরু করেছে।’’, বলছিলেন মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস নেতা অতুল লোন্ধে। তাঁর যুক্তি, ‘‘লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি টের পেয়েছে, মরাঠা, মুসলিম ও দলিতরা কংগ্রেস তথা মহা বিকাশ আঘাড়ীকে ঢেলে ভোট দিয়েছে। তাতেই বিজেপির আসন সংখ্যা ২৩ থেকে নয়ে নেমে এসেছে। এ বার তাই ধর্মের নামে হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করতে বিজেপি মরিয়া।’’
পৃথ্বী থিয়েটারের বইয়ের দোকানে আল পাচিনো, কমল হাসনের আত্মকথা, গুলজারের কবিতার অনুবাদের সঙ্গে ‘মোদী’জ ইন্ডিয়া’ বইও বিক্রি হচ্ছে। বলিউডের পরিচিত মুখরা নাট্যোৎসব দেখতে ভিড় করছেন। আইরিশ কফি, বান মাস্কা-র সঙ্গে নিচু গলার আড্ডায় বারবার ভোটের রাজনীতি ফিরে আসছে। আপনারা কেন ধর্মের নামে রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হন না? প্রশ্ন শুনে মুম্বইয়ের এক দাপুটে অভিনেতা মুখ বন্ধ রেখে পৃথ্বী থিয়েটারের দেওয়ালে ঝোলানো একটি পোস্টারের দিকে ইশারা করলেন। তাতে লেখা—‘খামোশ! শোর মাচায়ে সির্ফ স্টেজ পর।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy