পহেলগামের হামলা গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্নের ভান্ডার খুলে দিয়েছে। আতশ কাচের নীচে চলে আসছে প্রতিবেশী বলয় এবং তার বাইরেও ভারতবিরোধী বা ভারতের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত সক্রিয়তার ক্ষেত্রে গোয়েন্দা বিভাগের অপারগতা। নাম গোপন রাখার শর্তে সংস্থার ভিতর থেকেই বলা হচ্ছে, পুঁজির অভাব, প্রযুক্তিতে টক্কর দিতে না পারা, রাজনৈতিক
বাধা, মনোবল ভেঙে পড়া, প্রশাসনিক ত্রুটির কারণে ধাক্কা খাচ্ছে দেশের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-সহ গোটা গোয়েন্দা পরিকাঠামো।
সূত্রের দাবি, জঙ্গিরা আগেই পহেলগামের জায়গাটি দেখে গিয়েছিল। গোপনে সহযোগিতা নিয়ে অস্ত্র জোগাড় করেছিল। হামলা চালানোর সময় জঙ্গিদের ভেস্টে লাগানো ছিল ক্যামেরা। হামলার সময়ের ছবি তুলেছিল তারা। অর্থাৎ গোটাটাই সুপরিকল্পিত! এখানেই প্রশ্ন উঠছে, জঙ্গিদের এত পরিকল্পনার বিন্দুমাত্র খোঁজই কেন পেলেন না গোয়েন্দারা? বিএসএফ-এর প্রাক্তন কর্তা সমীর মিত্র যেমন বলেছেন, দেশের নিরাপত্তা সংস্থার পারদর্শিতার অভাবের কথা। প্রশ্ন
উঠছে, পহেলগাম, গুলমার্গ, সোনমার্গে প্রচুর ভিড় হয় জানা সত্ত্বেও ন্যূনতম নিরাপত্তা ছিল না কেন? হত্যালীলার পরও নিরাপত্তাবাহিনীর সেখানে আসতে ঘণ্টাখানেক দেরি
হয় কেন?
রাজনৈতিক সূত্রে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ উঠছে, দেশে এবং বিদেশে ভারতের নিরাপত্তা এবং নীতির দায়িত্বে থাকা তিন কর্তা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ঘটনায় বারবার সামনে এসেছে এই প্রসঙ্গে। ডোভাল এবং জয়শঙ্করের মধ্যে ‘অসদ্ভাব’ রয়েছে বলে চর্চা জোরদার। গত অগস্ট মাসে ভারতের নাকের ডগায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে যে রাতারাতি নতুন জমানা ক্ষমতায় বসে পড়বে তার কোনও খোঁজ, এক সপ্তাহ আগেও পায়নি গুপ্তচরবাহিনী। শেষ মুহূর্তে সে দেশের সেনা সহায়তা ছাড়া শেখ হাসিনাকে রক্ষা করা সম্ভব হত কি না, সে চর্চা যথেষ্ট। এই তিন কর্তার মধ্যে তালমিলের অভাবই দেশের নিরাপত্তার বুননকে পলকা করছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে।
পাশাপাশি আমেরিকায় খলিস্তানপন্থী উগ্রবাদী গুরপতবন্ত সিং পন্নুনকে হত্যার চেষ্টা ও কানাডায় খলিস্তানপন্থী হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক স্তরে মুখ পুড়েছে ভারতের। ভারতীয় গুপ্তচর বিভাগের নাম জড়িয়ে যাওয়া নিয়ে আমেরিকা এবং কানাডার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে উথালপাথাল যেমন হয়েছে, তেমন কিছুটা হলেও মনোবল ধাক্কা খেয়েছে ‘র’-এর, এমনটাই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। নিজেদের আড়াল ফাঁস হয়ে যাবে এই ভয় তৈরি হয়েছে।
সূত্রের খবর, সমস্যা গভীরেও। ২০০৮ সালে মুম্বই হামলার পর তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম ‘ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজ়ম সেন্টার’ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। দেশের নিরাপত্তা পরিকাঠামোর আমূল বদল ছিল তাঁর লক্ষ্য। সেই প্রস্তাবে গোয়েন্দা তথ্য ভাগ করে নেওয়ার ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশের মধ্যে প্রশাসনিক দূরত্ব কমিয়ে চটজলদি ব্যবস্থা নেওয়া, দ্রুত দেশের যে কোনও রাজ্যে থেকে গ্রেফতার করা, নথি বাজেয়াপ্ত করার মতো অনেক সংস্কারমূলক প্রস্তাব ছিল, রাজ্যের গণ্ডিকে অতিক্রম করেই। কিন্তু রাজনৈতিক এবং অন্য কারণে, সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি। তা হলে সমস্যার অনেকটাই সুরাহা হত বলে মনে করা হচ্ছে।
এখনও সীমান্তে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্যাটেলাইট নির্ভর ‘থার্মাল ইমেজিং’ পরিকাঠামো নেই। যা ভারতের পশ্চিম এবং পূর্ব উভয় দিকেই অনুপ্রবেশ রোধের ব্যবস্থাকে কিছুটা দুর্বল করে রেখেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। আধা সামরিক বাহিনী এবং আইপিএস ক্যাডারদের থেকে গুপ্তচর সংস্থায় কিছু দিনের জন্য চুক্তিভিত্তিক ক্যাডার নিয়োগ করার বিষয়টিও সমালোচিত হচ্ছে। বক্তব্য, আধা সামরিক বাহিনী থেকে যাঁরা আসেন, তাঁরা শারীরিক ভাবে অত্যন্ত বলশালী ঠিকই। কিন্তু গুপ্তচরের যে প্রশিক্ষণ, গুণাবলি ও দক্ষতা প্রয়োজন, তার সঙ্গে শারীরিক ভাবে বলশালী হওয়ার ততটা সম্পর্ক নেই। শারীরিক সম্পদ নয়, ‘র’-এর মূল সম্পদ ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, নিজেকে আড়ালে রেখে তথ্য সংগ্রহ করা এবং নেটওয়ার্ক তৈরি করার ক্ষমতা। আইপিএস থেকে আসা ক্যাডাররাও এই বিভাগটিকে নিছকই সাময়িক উন্নতির সোপান হিসেবেই ব্যবহার করে ফিরে যান স্বস্থানে। তাঁদের সেই দায়বদ্ধতা থাকে না। ফলে ইয়েমেনে সৌদির আক্রমণ হোক, বা মলদ্বীপে ভারত বিরোধিতার বিপুল ঢেউ, ভারতের বহু ছাত্রছাত্রী সমৃদ্ধ ইউক্রেনে হামলার খবর, বাংলাদেশে জমানার পরিবর্তন আগে থেকে আঁচ করে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্নে একের পর মার খাচ্ছে ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ। যার নবতম উদাহরণ পহেলগামে হামলা।
সূত্রের খবর, অন্য রাষ্ট্রের মাটিতে বিপদের ঝুঁকি নেবেন এমন চর তৈরি করতে এবং তাঁকে দীর্ঘদিন কর্মরত রাখতে খরচ যথেষ্ট। সব মিলিয়ে এখন যা অর্থ সরকার থেকে বরাদ্দ করা হয়েছে তা বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। সেটা কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠছে। ফোনে আড়ি পেতে খবর পাওয়ার বিষয়টি আজকের দিনে অচল হতে বসেছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও বিদেশি অ্যাপে জঙ্গিদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ চলে, নিজের দেশে ওই অ্যাপগুলির সার্ভার না থাকলে যার নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। সেটাও বড় সমস্যার জায়গা বলে মনে করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে চিনের মতোই আরও সক্রিয় হতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)