—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
‘কত দিন ধরে টাকা হাতানোর এই কাজ করছেন?’
প্রতারক: ‘ তিন-চার দিন হল।’
‘ভাল ভাবে বলছি। টাকাটা ফেরত দিন।’
প্রতারক: ‘ভাল কথা বলতে হবে না। খারাপ ভাবেই বলুন।’
‘কত টাকা নিয়েছেন?’
প্রতারক: ‘সাড়ে তিন লক্ষ।’
‘ডায়ালিসিস রোগীর টাকা নিয়েছেন। চিকিৎসা চলছে। টাকাটা ফেরত দিন।’
প্রতারক: ‘ফেরত দেব না। বুড়ো মানুষ অত টাকা নিয়ে কী করবে?’
‘আপনি কোথায় বসে কথা বলছেন। সব কিন্তু দেখা যাচ্ছে।’
প্রতারক: ‘তাই নাকি? তা হলে আমার বাড়ি এসে টাকা নিয়ে যান।’এর পরে ফোন কেটে দেওয়া হয়।
যে নম্বর থেকে ফোন করে ওটিপি জেনে এক বৃদ্ধের সারা জীবনের সঞ্চয়ের অনেকটাই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, সেই নম্বরে যখন বৃদ্ধের পরিবারের এক সদস্য ফোন করলেন, একটুও গলা কাঁপল না প্রতারকের। উল্টে সে বলল, ‘দরকার পড়লে আরও নেব।’ কথোপকথনের এই রেকর্ডিং (আনন্দবাজার এই রেকর্ডিং যাচাই করেনি) প্রতারিতের পরিবারের তরফে দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। জামতাড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ফোনটি করা হয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত হলেও কবে সেখানে হানা দেওয়া হবে, তা জানাতে পারেনি তারা। উল্টে জামতাড়া পুলিশের কাছে বিষয়টি পৌঁছেছে ঘটনার প্রায় চার দিন বাদে। তত দিনে পরিবারের লোক ফোন করেছেন। কলকাতা পুলিশ থেকেও ফোন গিয়েছে প্রতারকের কাছে। আপাতত বন্ধ নম্বরটি। প্রশ্ন উঠছে, এই কারবার ধরতে পুলিশ দ্রুত কেন সক্রিয় হয় না?
এ ক্ষেত্রে প্রতারিতের নাম মুকুল বণিক। অশীতিপর বৃদ্ধের বাড়ি হুগলির উত্তরপাড়ায়। মেয়ের বিয়ে হয়েছে শোভাবাজারে। লকডাউনের পর থেকেই স্ত্রী, ৬৯ বছরের মিনাকে নিয়ে তিনি বেশির ভাগ সময়ে মেয়ের কাছে থাকেন। বৃদ্ধের অ্যাকাউন্ট রয়েছে উত্তরপাড়ায় একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের শাখায়। অভিযোগ, তাঁকে ওই ব্যাঙ্কের ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে ফোন করে বলা হয়, ‘প্যান কার্ড আপডেট না করালে এটিএম কার্ড বন্ধ হয়ে যাবে।’ সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য প্রতারককে সমস্ত তথ্য বলে দেননি বৃদ্ধ। প্রথমে জানিয়ে দেন, স্ত্রীকে নিয়ে জরুরি কাজে বেরোচ্ছেন, পরে কথা হবে। স্ত্রীর গত আট বছর ধরে ডায়ালিসিস চলছে। সেই কাজেই বেরোচ্ছিলেন। অভিযোগ, ফোনে তাঁকে বলা হয়, ‘‘হাসপাতালে যাচ্ছেন ডায়ালিসিস করাতে, এটিএম কার্ড বন্ধ হলে কী হবে?’’
বৃদ্ধের পরিবারের দাবি, উত্তরপাড়ার ওই ব্যাঙ্কের এক কর্মী তাঁর কাজ দেখভাল করেন। ওই কর্মীকে বলা ছিল, ডায়ালিসিস করানোর দিনগুলোতে বৃদ্ধকে ব্যাঙ্কের কাজে ডাকলে পাওয়া যাবে না। বৃদ্ধ ফোনে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ককর্মীর নাম করে বলেন, ‘‘ওঁর সঙ্গে কথা বলে পরে করে নেব।’’ বৃদ্ধকে বলা হয়, ‘‘ও আজ ছুটিতে। তাই আমি নিজে ফোন করছি।’’ ম্যানেজার নিজে ফোন করছেন ভেবে এরপর ওটিপি বলে দেন বৃদ্ধ।
বৃদ্ধের মেয়ে সোমালিনা দাঁ বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘জীবনের যাবতীয় সঞ্চয় উত্তরপাড়ার ওই ব্যাঙ্কে রেখেছিলেন বাবা। মাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই বাবা বোঝেন যে তিনি ভুল করে ফেলেছেন। দ্রুত ব্যাঙ্কে ফোন করেন। ব্যাঙ্ক জানিয়ে দেয়, বাবাকেই টোল ফ্রি নম্বরে ফোন করে কার্ড বন্ধ করাতে হবে।’’ হাসপাতালে পৌঁছে তখন ডায়ালিসিস করানোর তাড়া, এ দিকে বৃদ্ধের হাত-পা কাঁপছে। সোমালিনা বলেন, ‘‘ওই অবস্থায় রেকর্ড করা নির্দেশ অনুযায়ী ১ টিপুন, ২ টিপুন আর বাবা করে উঠতে পারেননি। প্রথমে ৫০ হাজার টাকা কেটে নেওয়ার মেসেজ আসে। বাবা ব্যাঙ্কে ফোন করে তা জানান। ব্যাঙ্ক ফের টোল ফ্রি নম্বরে ফোন করতে বলে। প্রায় মিনিট দশেকের মধ্যেই সাত দফায় প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা নেওয়া হয় বাবার অ্যাকাউন্ট থেকে।’’
জামতাড়ার প্রতারণাচক্রের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তির দাবি, প্রথমে যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে তথ্য বার করা হয়। এর পর ফোন নম্বর-সহ তালিকা তৈরি করা হয়। মূলত বয়স্ক এবং বিশেষ ভাবে সক্ষম কারও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মোটা টাকা রয়েছে জানতে পারলে তাঁকে রাখা হয় তালিকার উপরের দিকে। টাকা দিয়ে সংশ্লিষ্ট ‘টার্গেট’ সম্পর্কে বার করা হয় যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য। এর পর ‘টার্গেট’কে ফোন করে ওই সব তথ্য বলে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা হয় যে আসল লোকই ফোন করেছেন। এক প্রতারক জামতাড়া সদর হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে বলছিল, ‘‘এখানে এসেছি এই এলাকার লোকের রিপোর্ট নিতে। কলকাতা বা সমস্ত বড় শহরে আমাদের এ রকম নেটওয়ার্ক রয়েছে।’’
জানা গেল, ব্যাঙ্কের কার্ড বন্ধ হয়ে যাবে, হাসপাতালে যে পরীক্ষা হয়েছে তার রিপোর্ট পাবেন না বা ভুল রিপোর্ট এসেছে— ইত্যাদি বলে ভয় দেখানো হয়। আর ভয় পেয়েই কথা এগোতে রাজি হয়ে যান অনেকে। এর পর ওটিপি জেনে নিয়ে টাকা বার করে নেওয়া সহজ ব্যাপার। কিন্তু পুলিশ ধরলে? কলকাতায় প্রতারিত ব্যক্তির উদাহরণ ধরেই এই কারবারে যুক্ত এক জনের দাবি, টাকা নিয়ে হয়তো আলাদা আলাদা অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাঁদের অ্যাকাউন্ট, তাঁরা হয়তো কেউ কৃষক, কেউ রিকশাচালক, কেউ চা বিক্রেতা। মাসে হয়তো তাঁদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক লেনদেন সাত-আটশো টাকার বেশি নয়। কিন্তু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ভাড়া দিয়ে মাসে বেশ কয়েক হাজার টাকা আয় হয়ে যায় তাঁদের। তবে পুলিশ ধরলেও খোয়া যাওয়া মোটা অঙ্কের টাকা ফিরিয়ে দেওয়া এঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।
সোমালিনা জানালেন, সাত দফায় কেটে নেওয়া টাকা ভোপাল-সহ দেশের নানা প্রান্তের বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে গিয়েছে বলে কলকাতা পুলিশ তাঁদের জানিয়েছে। সোমালিনার দাবি, গত শুক্রবারই তাঁর বাবার ফিক্সড ডিপোজ়িট-এর টাকা অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে। প্রতারক কি তবে ফিক্সড ডিপোজিট-এর খবরও জানত? জামতাড়ার ওটিপি মাফিয়ার দাবি, তথ্যই তাদের প্রতারণা ব্যবসার মূল অস্ত্র। যার কাছে যত তথ্য, তার ব্যবসার তত রমরমা।
তা হলে উপায়? লালবাজারের সাইবার শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম-কমিশনার পদমর্যাদার এক পুলিশ কর্তা বললেন, ‘‘ফোনে কোনও লিঙ্কে ক্লিক বা কিছু ডাউনলোড করতে বললে এড়িয়ে যেতে হবে। আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত কোনও কথাই ফোনে বলা চলবে না। ধরে নিতে হবে, আপনার সম্পর্কে সমস্ত তথ্য তাদের জানা। শুধু জানে না, সদ্য তৈরি হওয়া ওটিপি। সেটা না দিলে বাকি সব জেনেও লাভ হবে না প্রতারকদের।’’
অর্থাৎ ওটিপি-ই প্রতিরোধের শেষ স্তম্ভ। ওটিপি না দিলেই জব্দ ওটিপি-মাফিয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy