জামতাড়ার মোহনপুরে এক প্রতারিতের বাড়ি। অভিযোগ এখান থেকেই চলে প্রতারণার করবার। —নিজস্ব চিত্র।
স্কুলে রোল নম্বর ডেকে দাঁড় করানোর মতো পর পর ডাকা হল চার জনকে। বিদেশি একটি নম্বর ধরিয়ে তাদের এক জনকে বলা হল ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। বাকি তিন জনের এক জনকে বলা হল মহারাষ্ট্র, এক জনকে অসম আর এক জনকে গুজরাতের নম্বরে ফোন করতে। ব্যাঙ্ককর্মী পরিচয় দিয়ে ইংরেজি, মরাঠি, অসমিয়া এবং গুজরাতি ভাষায় কথা শুরু করল চার জন। কিন্তু কেউই বিশেষ সুবিধা করতে পারল না। এক-দু’টি কথা বলার পরেই উল্টো দিক থেকে ফোন কেটে দেওয়া হল। বিব্রত চারজনই।
‘টার্গেট’ অপূর্ণ! চার জনের এক জন বলে উঠল, ‘‘ওটিপি চাইতে গেলেই তো আজকাল ফোন কেটে...!’’ কথা শেষের আগেই প্রবল ধমক দিয়ে উঠে দাঁড়াল মাঝ উঠোনে খাটিয়ায় বসে থাকা নেতা গোছের এক তরুণ। ফোন যারা করছিল, তাদের কাছে জানতে চাইল শিক্ষাগত যোগ্যতা। চার জনের এক জন শুধু জানাল স্কুলের গণ্ডি পার করার কথা। বাকিরা ষষ্ঠ শ্রেণিও পেরোয়নি। আরও গলা চড়িয়ে ধমকে তরুণ বলল, ‘‘নিজেদের ব্যাপারে দু’লাইন করে বলো তো!’’ শর্ত দিল, যে ভাষায় ফোন করে প্রতারণার ফাঁদ পাতা হচ্ছিল, কথা বলতে হবে সেই ভাষাতেই। বাক্য বলা তো দূর, আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রত্যেকে।
ক্লাসে ফাঁকি নেই। ‘ব্যর্থ শিক্ষার্থীদের’ বলা হল, ‘‘কাউকে ফোন করে ঠকাতে হলে তাঁর ভাষায় কথা বলা জরুরি। টাকা বার করে আনতে চার থেকে পাঁচ মিনিট সময় ফোনে কথা বলতে হয় সাধারণত। ওই সময়টুকুতে যা যা বলা প্রয়োজন হতে পারে, সেটুকু লিখে দেওয়া হয়। মুখস্থ করে নিতে পারলেই হল।’’ এর পরে সগর্ব উক্তি, ‘‘আমাদের মতো বিএ পাশ করা লোক এই কাজে আর ক’জন!’’
যেখানে বসে কথা হচ্ছিল, সেটা জামতাড়ার কর্মাটাঁড় ব্লক। ১৮৭৩ সাল নাগাদ এই গ্রামে এসে ওঠেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। লাল মোরামের চড়াই-উতরাই পথ। শাল, পলাশ, নিম গাছের জঙ্গলে ঘেরা এই গ্রামের টানে জীবনের দীর্ঘ ১৮ বছর এখানেই থেকে যান তিনি। জমি কিনে এখানেই শুরু করেন একাধিক সমাজ সংস্কার কর্মসূচি। নিরক্ষর পুরুষদের জন্য সান্ধ্য স্কুল খোলার পাশাপাশি মেয়েদের স্কুল খোলেন। গড়ে তোলেন হোমিয়ো চিকিৎসাকেন্দ্র। পরে ১৯৭৪ সালে ভারতীয় রেলের তরফে এই কর্মাটাঁড় স্টেশনের নাম দেওয়া হয় বিদ্যাসাগর রেল স্টেশন। বছর কয়েক আগে স্টেশনটিকে হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়। ঝাড়খণ্ড রাজ্য হওয়ার পরে এই কর্মাটাঁড় ব্লকের নাম দেওয়া হয় বিদ্যাসাগর ব্লক।
অভিযোগ, বিদ্যাসাগরের স্মৃতি বিজড়িত এই ব্লক এখন শিক্ষার প্রসারে অনেকটাই পিছিয়ে। উল্টে এই ব্লকই সাইবার প্রতারণায় এখন জামতাড়ার মধ্যে হয়ে উঠেছে সবচেয়ে কুখ্যাত। এখানকার ঝিলুয়া, পাবিয়া, খড়বনিয়া, সিয়াটাঁড়ে গোয়েন্দাদের নিত্য যাতায়াত। মোহনপুর আর নারায়ণপুরের দিক থেকে এই কর্মাটাঁড় ব্লকে ঢোকার ক্ষেত্রেই আবার চলতে থাকে চোর-পুলিশ খেলা। সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই মাস মাইনে করা মোটরবাইকে সওয়ার লোক দ্রুত খবর দিয়ে দেয়। সাইবার প্রতারণার ‘অফিসঘর’ দ্রুত বদলে যায় সাধারণ বসত ভিটেয়। জঙ্গলের ভিতরে বা গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে বসে ফোনের এই কারবার চলে, সেই জায়গা দ্রুত ফাঁকা হয়ে যায় মোটরবাইক বাহিনীর খবর এলেই। শোনা যায় মহিলাদের গ্রাম পাহারা দেওয়ার গল্পও। তাড়া খেয়ে ফিরতে হয় পুলিশকেও।
এই ব্লকেরই একটি মোবাইল ফোনের দোকানে বসে কথা হচ্ছিল দোকান-মালিকের সঙ্গে। জানালেন, এই গ্রামে এমন কোনও ঘর নেই, যেখান থেকে কেউ না কেউ সাইবার অপরাধে জেল খাটেনি। এখনও হাজতে অনেকে। কিন্তু জামিন পেয়ে বেরিয়েই অনেকে ফের একই কাজ শুরু করে। তাঁর দাবি, এই কাজে যুক্ত হওয়ার প্রলোভন এই তল্লাটে মুখে-মুখে ফেরে। দৈনিক ২০০ টাকা মজুরির কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের পরিবারের ছেলে-মেয়েদেরই বেশি করে প্রস্তাব দেওয়া হয়। কারণ এই কাজে মাসে লক্ষাধিক টাকা আয়। তিনি বলেন ‘‘একজন হয়তো কাউকে ঠকিয়ে কিছু টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সেই টাকায় দামি পোশাক, মোটরবাইক কিনে ঘুরছে। ঠাটবাট মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। তাকে দেখে পাশের বাড়ির ছেলেটাও উৎসাহী হয়। এই প্রতারণার কাজ একটা গোটা প্রজন্মকে শেষ করে দিচ্ছে।’’
ওই দোকান মালিকের সূত্রেই এর পরে কথা হল তাঁর পরিচিত সাইবার প্রতারণা চক্রের সঙ্গে যুক্ত এক তরুণের সঙ্গে। ‘দেখা করতে চাই’ জানিয়ে ফোনে কথা বলার পরে মোহনপুর মোড়ে একটি গাছের নীচে অপেক্ষা করতে হল প্রায় দেড় ঘণ্টা। শেষের তিরিশ মিনিট দেখা গেল, একাধিক মোটরবাইক গাছটির কাছে এসে ঘুরে যাচ্ছে।
এমনই একটি বাইকের চালক এর পরে কাছে এসে দাঁড়িয়ে পিছনে বসতে বলল। মিনিট কুড়ি গ্রামের এ রাস্তা-ও রাস্তায় ঘুরে সেই মোটরবাইক থামল একটি বাড়ির সামনে। চারতলা বাড়ি। সামনে বাগান। পর পর দাঁড়িয়ে তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি। রয়েছে একাধিক মোটরবাইক। গেট পাহারার মতো করে দাঁড়ানো কয়েক জন বলল, মোবাইল ফোন জমা রেখে ভিতরে যেতে হবে। নির্দেশ মতো কাজ করার পরেও তল্লাশি হল কয়েক দফায়।
দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই বাড়ির মাঝ বরাবর উঠোন। এক দিকে গোয়াল ঘরের পাশে রান্না হচ্ছে। ওই দিকটা বাদ দিলে বাড়িটার সাজসজ্জা যে কোনও শহুরে আধুনিক বাড়ির মতোই। উঠোনের মাঝে খাটিয়া পেতে দিল দুই যুবক। হাফ ট্রাউজ়ার্স আর টি-শার্ট পরা এক যুবক এর পরে সেখানেই এসে বসল। বয়স ৩৫-৪০ বছর। এক দু’-কথা হতে না হতেই হঠাৎ চিৎকার করে উঠল যুবক। গলায় ঝোলানো হেডফোনের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘‘ক্যামেরা করছেন?’’ হেডফোন খুলে হাতে ধরাতেই সেটা ছুড়ে দিল উঠোনের এক কোণে। ডাক পড়ল সেই চার জনের। নানা ভাষায় ফোন করিয়ে সমস্তটা দেখিয়ে যুবক এর পর বলল, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের কাছে আমরা ঋণী। আপনাদের ওখানে তো ছাতা লাগিয়ে সিমকার্ড বিক্রি হয়। ভাগ্যিস হয়। না হলে এত সিমকার্ড আমরা পেতাম কোথায়?’’
যুবকের দাবি, বৈধ সিমকার্ড দিতে সাধারণত এক বার বায়োমেট্রিক যন্ত্রে আঙুল ছোঁয়ালেই চলে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নানা অজুহাতে দু’-তিন বার করে আঙুল ছোঁয়াতে বলা হয়। ওই আঙুলের ছাপ দিয়ে আর পরিচয়পত্রের ছবি বদলে তৈরি হয় ভুয়ো নথি। সেই দিয়েই চালু করা হয় একের পর এক বেআইনি সিমকার্ড। এই প্রতারণার বাজারে নাকি এক-একটা সিম কার্ডের দর ওঠে প্রায় দু’হাজার টাকা। এর পরে বেনামে আনানো এই সিম কার্ড মোবাইলে ভরে ফোন করলেই হল। যুবকের কথায়, ‘‘দশটা ফোন ঘোরালে অন্তত তিন জন তো এমন থাকবেনই, যাঁদের টাকা হাওয়া করে দেওয়া যাবে! সিমকার্ড খুলে ফেলে দিলেই কারও ধরার ক্ষমতা নেই। যে ফোন নম্বর থেকে ফোন এসেছিল, সেটা ধরে খুঁজতে গেলেও পুলিশ পৌঁছবে যাঁর নামে সিম কার্ড নেওয়া, তাঁর কাছে। এখানে বসে প্রতারণা করব, কিন্তু সিমকার্ড হয়তো বনগাঁর কারও নামে!’’
কিন্তু এত যে গ্রেফতারি হচ্ছে? যুবকের উত্তর, ‘‘যারা ধরা পড়ছে, সব ছোটখাটো প্রতারক। আমাদের কেউ ছুঁলে মোটা হিসাবের খাম ধরিয়ে দিই। খামের জোর থাকলে সব সেটিং হয়ে যায়। তা ছাড়া, বড় কারবারিদের কাছে যা টাকা আছে, তাতে এক সিমকার্ড দ্বিতীয় বার ব্যবহারের প্রয়োজনই পড়ে না। প্রয়োজনে ব্যবহৃত ফোন মোবাইল দোকান মারফত বাইরে বিক্রি করিয়ে দিই। স্থানীয় ভাষায় এই ফোনগুলোকে আমরা বলি চরকি ফোন। হয় বিক্রি করি, নয় এমন ফোন আমরা ভেঙে ফেলি।’’
কান টানলে মাথা আসে। কিন্তু যদি কানই না থাকে? এ ক্ষেত্রে তো ফোনটাই নেই। ভ্যানিশ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy