স্কুলের পোশাকেও মোটরবাইক নিয়ে গ্রাম পাহারায়। —নিজস্ব চিত্র।
আমাদের গাড়ির ঠিক আগে-আগে ছুটছে একটা মোটরবাইক। যিনি চালাচ্ছেন তাঁর মুখ গামছায় ঢাকা। যেন গতির প্রতিযোগিতায় নেমেছে আমাদের গাড়ির সঙ্গে! কিছু দূর চলার পরেই একটি গাছের কাছাকাছি পৌঁছে সজোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল সেই মোটরবাইক। আচমকা। চালক শুরু করলেন হর্ন বাজানো। একটানা।
ওই গাছের নীচেই এতক্ষণ আর একটি মোটরবাইকের সিটের উপরে পা তুলে আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন এক যুবক। হর্ন শুনেই লাফিয়ে উঠে নিজের মোটরবাইক স্টার্ট দিলেন তিনি। ততক্ষণে আমাদের গাড়ি ওই গাছ পেরিয়ে গিয়েছে। ওই বাইকও ঝড়ের গতিতে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। থামল বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়ানো আর এক মোটরবাইকের কাছে। ফের সেই একই ভাবে হর্ন বাজানো!
এ বারের বাইকের চালক দাঁড়িয়ে ছিলেন কাছেই। গলায় ঝোলানো গামছার আগা ধরে তিনি ছুড়ে দিলেন ঘাড়ের উপরে। কোনওমতে মুখ ঢেকে এর পরে পড়িমড়ি করে গ্রামের আরও ভিতরের দিকে ছোটাতে শুরু করলেন মোটরবাইক।
যেন ‘রিলে-রেস’ চলছে! এক জনের থেকে ব্যাটন নিয়ে সামনের দিকে ছুটছেন আর এক জন! জামতাড়ায় পৌঁছে ভাড়ায় নেওয়া গাড়ির চালক স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে বললেন, ‘‘আমাদের খবর পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। গ্রামের মাথায়-মাথায় ওদের লোক লাগানো আছে। সারাদিনের জন্য চার-পাঁচশো টাকা মজুরি। সন্দেহ হলেই একটা বাইকআর এক বাইকের কাছে গিয়ে হর্ন বাজিয়ে ‘সিগন্যাল’ দেবে। সেই বাইক সিগন্যাল দেবে পরের বাইকের কাছে গিয়ে। এ ভাবে যতক্ষণে আমি, আপনি, পুলিশ— গ্রামের ভিতরে ঢুকব, ততক্ষণে এদের মারফত খবর পৌঁছে যাবে।’’
কিন্তু আমরা তো পুলিশ নই! সন্দেহ হল কেন? চালকের উত্তর, ‘‘ওরা বাইরের লোক দেখলেই সতর্ক হয়ে যায়। সে যে-ই হোক।’’
কী কারণে এসেছি, তার কিছুই স্পষ্ট করে বলা হয়নি মাঝবয়সি এই গাড়িচালককে। শুধু বলে রাখা ছিল, ঝাড়খণ্ডের এই অংশের উন্নয়ন কেমন হয়েছে, সেটাই দেখতে আসা। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য অবশ্যই দেশের ‘সাইবার প্রতারণার রাজধানী’তে এসে ‘ওটিপি মাফিয়া’দের কাহিনি জানার চেষ্টা। গত ১২-১৩ বছর ধরে যারা গোটা দেশের পুলিশ-প্রশাসনের মাথাব্যথা।
কখনও পাট খেতের মধ্যে বসে দেশের যে কোনও প্রান্তে ফোন করে ব্যাঙ্কের কার্ড বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) জেনে নিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। কখনও বিদেশে কাউকে ফোন করে একই পদ্ধতিতে ওটিপি জেনে উধাও করে দেওয়া সারা জীবনের সঞ্চয়। এমনও বহু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে ওটিপি-রও প্রয়োজন পড়েনি। নজরদারি চালানো সম্ভব এমন কোনও ‘অ্যাপ্লিকেশন’ মোবাইলে ডাউনলোড করিয়ে ‘হাওয়া করে দেওয়া গিয়েছে’ রোগীর শেষ সম্বল। নিত্যনতুন প্রতারণার পদ্ধতি বার করার কাজে প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই সামনে এসেছে জামতাড়ার নাম।
হাওড়া-পটনা বন্দে ভারত ধরে জামতাড়ায় পৌঁছনোর পরে কথা হচ্ছিল সেখানকার স্টেশনের এক রেলকর্মীর সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘‘এক সময়ে টিমটিমে আলোর নীচে কোনওমতে রেল পরিষেবা দেওয়া জামতাড়ায় এখন ঝাঁ-চকচকে স্টেশন। নতুন সিঁড়ি, শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত যাত্রী প্রতীক্ষালয়। সারা দেশের নানা প্রান্তের তদন্তকারীদের নিয়মিত যাতায়াত লেগে থাকায় বন্দে ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনও এখন দাঁড়াচ্ছে জামতাড়া স্টেশনে।’’
এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাইরে বিশাল জাতীয় পতাকা উড়ছে। এলাকা মোটামুটি জমজমাট। দু’নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে বেরোনোর পরে দেখা গেল, একটি মন্দির লাগোয়া বাজারও রীতিমতো গমগম করছে। স্থানীয় অটো, টোটো স্ট্যান্ড পার করে কিছুটা এগোতেই সুভাষ চক লাগোয়া বাজারে তৈরি হয়েছে ‘নিউ টাউন’। বহুজাতিক বিপণির পাশাপাশি সেখানে খুলেছে একাধিক হোটেল-রেস্তরাঁ। কিন্তু জানা গেল, এখনও বেশির ভাগ স্থানীয় মানুষ দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। ভুট্টা, ছোলা, পাট ছাড়া সে ভাবে কোনও চাষাবাদ নেই। বৃষ্টির পরে কিছুটা ধান চাষ হলেও, কিছু দিনের মধ্যেই বদলে যায় সেই জমির চেহারা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে রয়েছে সিধো-কানহোর সিমেন্টে বাঁধানো মূর্তি। মানভূম অঞ্চলের ইতিহাস আর অনুন্নয়নের স্মৃতিকে সঙ্গে করেই।
হোটেল ঘুরিয়ে দেখানোর মধ্যেই এক টোটোচালক বলছিলেন, “এখানে এখনও দু’শো টাকা রোজের হিসেবে কাজ করা লোকের সংখ্যা বেশি। এক-একটা গ্রামে হাতে গোনা কয়েক জন হয়তো বাইরে চাকরি করেন। আর আছে ‘এটিএম চোর’। এমনও গ্রাম আছে, যেখানে এমন ঘর নেই, যার কেউ না কেউ হাজতে যায়নি! কিন্তু তাদের বাড়ি দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। দু’দিন আগেও যারা খেতে পেত না, এখন তাদের বাড়ির সামনে বড় গাড়ি। একাধিক মোটরবাইক।” টোটো চালক জানান, প্রতারকের খপ্পর থেকে বাদ যায় না এলাকার মানুষও। বললেন, “আমার ছেলের চাকরি পাকা হয়ে গিয়েছে বলে ফোন করেছিল। ব্যাঙ্কের সব তথ্য জেনে আমার কাছে আসা চার সংখ্যার একটা নম্বরও জেনে নিয়েছিল। ব্যাঙ্কে ছ’হাজার টাকা পড়ে ছিল। সেটুকুও ওরা নিয়ে নিয়েছে।”
২০০১ সাল পর্যন্ত জামতাড়া ছিল দুমকা জেলার অন্তর্গত। মেরেকেটে ২৪ বছর বয়সি এই জেলার রাস্তা ধরে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল অসাম্যের ছবি। মসৃণ পিচ রাস্তার পরেই এবড়ো-খেবড়ো ভঙ্গুর পথ। মাটির ঘরের পাশেই চারতলা পাকা বাড়ি। গরুরগাড়ির পাশেই ছুটছে দামি বিলাসবহুল চারচাকা। মাঝেমধ্যেই গতির তুফান তুলে বেরিয়ে যাচ্ছে মোটরবাইক। যেমন আমাদের খবর পৌঁছে দিতে ছুটেছিলেন ওই মোটরবাইক চালক।
জামতাড়া লাগোয়া নারায়ণপুর থানা এলাকার গ্রামের মুখে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল এক বৃদ্ধের সঙ্গে। তাঁরও অভিযোগ, প্রতারকের ফোন ধরে খোয়াতে হয়েছে সর্বস্ব। বৃদ্ধ বলেন, “এই চোরদের বুদ্ধি খুব। ভাল কাজে লাগালে এলাকার উন্নতি হত। তার বদলে আমাদের জামতাড়া বদনাম হয়ে গিয়েছে।” ‘মহাবিদ্যার’ অন্ধকারে এখনআলো খোঁজাই নিরর্থক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy