উপদ্রুত জাফরাবাদ। ছবি- এএফপি।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে দিল্লিতে সংঘর্ষের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হল ৩৭। বুধবার ছিল ২৭। জখম হয়েছেন ২০০-রও বেশি মানুষ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শান্তি ফিরিয়ে আনার আবেদন জানানো ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের উপদ্রুত এলাকা সফরের পরেও বুধবার অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গিয়েছে ভজনপুরা, মৌজপুর ও কারাওয়াল নগর এলাকাগুলিতে। মৌজপুর, জাফরাবাদের মতো বেশ কয়েকটি এলাকার পরিস্থিতি এখনও থমথমে।
গুরু তেগ বাহাদুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ৩০ জনেরই মৃত্যু হয়েছে ওই হাসপাতালে। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন এক মহিলাও। ৯ জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি করানো হয়েছিল হাসপাতালে। দু’জনের মৃত্যু হয়েছে এলএনজেপি হাসপাতাল আর এক জনের মৃত্যু হয়েছে জগ পরবেশ চন্দ্র হাসপাতালে। সোমবার সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছিলেন দিল্লি পুলিশের হেড কনস্টেবল রতন লাল।
দিল্লি পুলিশ এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ১৮টি এফআইআর দায়ের করেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ১০৬ জনকে।
বুধবার সন্ধ্যায় নিরাপত্তা কর্মীদের কনভয় নিয়ে ফের উপদ্রুত এলাকাগুলি ঘুরে দেখেন ডোভাল। যান সবচেয়ে উপদ্রুত এলাকাগুলির অন্যতম জাফরাবাদে। বুধবার শান্তি ও সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার আবেদন জানিয়েছেন দিল্লির মুখ্য়মন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালও।
আরও পড়ুন: ‘প্রশাসন নিষ্ক্রিয়’, দিল্লিতেও গুজরাত দাঙ্গার ‘মডেল’ দেখছেন বিরোধীরা
আরও পড়ুন: মাঝরাতেই বদলি দিল্লির ‘রক্ষাকর্তা’ সেই বিচারপতি
গত কাল দুপুরে জাফরাবাদের মেট্রো স্টেশনের নীচের রাস্তা আজ সুনসান। একটু দূরে মৌজপুর চকেও রাস্তা ছিল জনমানুষ শূন্য। শনিবার থেকে জাফরাবাদেই সিএএ-বিরোধীরা রাস্তা অবরোধ করেছিলেন। রবিবার থেকে পাল্টা সিএএ-র পক্ষে জমায়েত শুরু হয়।
জোহরাপুরী-ভজনপুরায় গত কাল নতুন করে দাঙ্গা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ লাগোয়া জোহরাপুরীতে পুলিশের সঙ্গেও দুষ্কৃতীদের সংঘর্ষ হয়েছে। রাতেও ভজনপুরা থেকে আটকে পড়া মানুষের ফোন এসেছে পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে। গভীর রাতে ব্রহ্মপুরী ও মুস্তাফাবাদ থেকে খবর আসে, ফের অশান্তি শুরু হয়েছে।
আহতের সংখ্যা ২০০ ছুঁইছুঁই। অনেকেরই মাথায় গুরুতর চোট। আহতদের অন্তত ৪৬ জনের শরীরে বুলেটের ক্ষত মিলেছে। আর একটি উদ্বেগজনক বিষয়, মুস্তাফাবাদ থেকে আজ বেশ কিছু আহত এসেছেন হাসপাতালে। তাঁদের অনেকের চোখে অ্যাসিড ঢালা হয়েছে। দৃষ্টি হারিয়েছেন চার জন। খুরশিদ নামে এক জনের দু’চোখই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তেগ বাহাদুর হাসপাতাল থেকে লোকনায়ক জয়প্রকাশ হাসপাতালে আসার জন্য অ্যাম্বুল্যান্সও পাননি তিনি। গিয়েছেন রিকশায়। দুই চোখ-সহ পুরো মুখ ঝলসে গিয়েছে ওয়কিলের। এ সব মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০০৩ সালের ‘গঙ্গাজল’ ফিল্মের কথা। অ্যাসিড দিয়ে চোখ গেলে দিয়ে পুলিশের বদলা নেওয়ার ভয়াবহ কাহিনি সেটি। এটা স্পষ্ট, আগুন লাগানো, পাথর ছোড়াছুড়ি, গুলির সঙ্গে ‘গঙ্গাজল (অ্যাসিড)’-এরও আয়োজন করা হয়েছে রীতিমতো আটঘাট বেঁধে। সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা গত কাল দিল্লি হাইকোর্টকে জানিয়েছেন, পুলিশকেও অ্যাসিড হামলার মুখে পড়তে হচ্ছে।
জাফরাবাদ-মৌজপুরে এখন শ্মশানের শান্তি। ফাঁকা রাস্তা জুড়ে পাথর, ইট, ভাঙা কাচ, ভাঙা লোহার রড। ভিতরের গলি থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে কালো ধোঁয়া। মৌজপুরের গলির একটি দোকানে আগুন নেভেনি। দোকানের মালিক কোন ধর্মের, তা দেখেই আগুন লাগানো হয়েছে। এ পাড়ায় ধর্মের জোরে যাদের দোকান বেঁচে গিয়েছে, অন্য গলিতে সেই ধর্মের জেরেই দোকান পুড়েছে। জাফরাবাদের এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘ভিতরের মহল্লায় অশান্তি চলছে। কোথায় কত জনের দেহ পড়ে রয়েছে, কেউ জানে না। পুলিশ এখনও ঢুকতে পারেনি ভিতরে।’’
চাঁদ বাগে গত দু’দিন ধরেই টানা অশান্তি চলছিল। গত কাল সেখানে নর্দমার মধ্যে ইন্টেলিজেন্স বুরোর তরুণ কর্মী অঙ্কিত শর্মার দেহ উদ্ধার হয়েছে। অভিযোগের আঙুল স্থানীয় আপ বিধায়ক তাহির হুসেনের দিকে। স্থানীয়দের অভিযোগ, মঙ্গলবার থেকেই হুসেনের বাড়ির ছাদ থেকে পাথর, পেট্রলবোমা ছোড়া হচ্ছিল।
খাজুরি খাসের গামরি এক্সটেনশনে মহম্মদ সইদ সালমানি মঙ্গলবার দুধ কিনতে বেরিয়েছিলেন। বাড়ি ঘিরে ফেলে হিংস্র জনতা। সালমানি ছুটে গেলেও পাড়ার লোকেরা তাঁকে বাড়ির দিকে যেতে দেননি। তাঁর দর্জির দোকানে পুড়েছে। মারা গিয়েছেন ৮৫ বছরের মা আকবরি। তেগ বাহাদুর ও লোকনায়ক জয়প্রকাশ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, হতাহতদের বেশির ভাগই গরিব বা মধ্যবিত্ত। ২৮ বছরের মুবারক হুসেন দ্বারভাঙা থেকে বাবরপুরে এসে শ্রমিকের কাজ করতেন। বিজয় পার্কে তাঁর বুকে গুলি লাগে। মুদাস্সির খান, শাহিদ খান আলভি অটো চালাতেন। রাহুল সোলাঙ্কি, বিনোদ কুমার, বীরভান সিংহেরা কেউ বাজার করে বা কাজ সেরে ফিরছিলেন। ভজনপুরার মারুফ আলিকে কপালে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে মারা হয়েছে।
দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত ১৮টি এফআইআর হয়েছে। ১০৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নিহতদের নিকটাত্মীয়কে দু’লক্ষ টাকা ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। গত কালই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জানিয়েছিলেন, দাঙ্গায় মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণের কোনও প্রশ্নই নেই। গত দু’দিন যে-সব এলাকায় অশান্তি হয়েছিল, সেখানে পরিস্থিতি তুলনামূলক ভাবে শান্ত।
কিন্তু ‘শান্ত’ মানে শান্তি নয়। নিরপত্তাও নয়। কাল দুপুরেই দেখা গেল, মুস্তাফাবাদে একমাত্র মেয়ের হাত ধরে প্রাণভয়ে মহল্লা ছাড়ছেন এক মহিলা। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই তাঁর মুখে। পিছনে ফেজ টুপি, কুর্তা-পাজামায় স্বামী। মাথায়-পিঠে ব্যাগ, লেপ-কম্বল। বাড়ি-দোকান পুড়েছে। পথে নেমেছেন নিরাপদ কোনও আশ্রয়ের খোঁজে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy