দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি যশবন্ত বর্মার সরকারি বাসভবন থেকে বিপুল পরিমাণে নগদ টাকা উদ্ধারের ঘটনার তদন্তে তিন বিচারপতির কমিটি তৈরি হল। তাঁকে আদালতের কাজকর্ম থেকেও সরিয়ে দেওয়া হল। অন্য দিকে এ দিন শীর্ষ আদালতের ওয়েবসাইটে নগদ উদ্ধারের ঘটনায় দিল্লি হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি কে উপাধ্যায়ের তদন্ত রিপোর্ট ও বিচারপতি বর্মার ব্যাখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে। এই ঘটনায় গভীরতর তদন্ত চেয়েছেন বিচারপতি উপাধ্যায়। অন্য দিকে বিচারপতি বর্মা স্পষ্ট জানিয়েছেন, ওই নগদের সঙ্গে তাঁর বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের কোনও সম্পর্ক নেই।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না আজ বিচারপতি বর্মার বাড়ি থেকে নগদ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় আদালতের নিজস্ব তদন্তের অঙ্গ হিসেবে তিন সদস্যের কমিটি তৈরি করেছেন। এই কমিটিতে রয়েছেন পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি শীল নাগু, হিমাচল প্রদেশের প্রধান বিচারপতি জি এস সান্ধাওয়ালিয়া এবং কর্নাটক হাই কোর্টের বিচারপতি অনু শিবরামন। একই সঙ্গে দিল্লি হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তিনি যেন বিচারপতি যশবন্ত বর্মাকে কোনও মামলা শোনার কাজ না দেন।
গত সপ্তাহে বিচারপতি বর্মার বাড়ির একাংশে আগুন লেগে যাওয়ায় সেখানে দমকল ও দিল্লি পুলিশ গিয়েছিল। আগুন নেভানোর সময়েই বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা উদ্ধার হয়। তার পরেই বিচারপতি বর্মাকে দিল্লি হাই কোর্ট থেকে ইলাহাবাদ হাই কোর্টে বদলির সুপারিশ করে সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম। ইলাহাবাদ হাই কোর্টেই বিচারপতি বর্মা প্রথম কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তার পরে দিল্লিতে বদলি হন। বিচারপতিকে বদলি করে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে কি না তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে সুপ্রিম কোর্ট শুক্রবার জানিয়েছিল, এ বিষয়ে আদালতের নিজস্ব অন্তর্তদন্ত শুরু হয়েছে। দিল্লি হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি কে উপাধ্যায়কে তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। তার সঙ্গে বিচারপতি বর্মার এ বিষয়ে ব্যাখ্যাও জমা পড়েছে। সেই রিপোর্ট পাওয়ার পরেই আজ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি তিন বিচারপতির তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।
ঠিক কত টাকা বিচারপতির দিল্লির বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল, তা নিয়ে সরকারি ভাবে কেউই মুখ খোলেননি। তবে ইলাহাবাদ হাই কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন ওই হাই কোর্টে বিচারপতির বর্মার বদলির প্রতিবাদে যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল, তাতে বলা হয়েছে নগদ ১৫ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছিল। ইলাহাবাদের বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অনিল তিওয়ারির প্রশ্ন, ‘‘আমজনতার বাড়ি থেকে ১৫ লক্ষ টাকা পাওয়া গেলে তার জেল হয়ে যায়। আর জজ সাহেবের বাড়ি থেকে ১৫ কোটি টাকা নগদ উদ্ধার হলে তাঁকে ছাড় দিয়ে শুধু নিজের হাই কোর্টে ফেরত পাঠানো হবে? এ কেমন বিচার?” তাঁর আশঙ্কা, ‘‘যদি বিচার বিভাগের উপর থেকে মানুষের আস্থা সরে যায়, তা হলে গোটা ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।’’ টাকা উদ্ধার নিয়ে প্রথমে দিল্লি দমকলের প্রধান অতুল গর্গ দাবি করেছিলেন, তাঁরা কোনও টাকা দেখতে পাননি। আজ আবার তিনি দাবি করেছেন, এমন কিছু তিনি বলেননি।
গোটা ঘটনায় বিচারপতি নিয়োগ থেকে আদালতের ভিতরের কাজকর্মে অস্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। আজ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দিল্লি হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি কে উপাধ্যায়ের তদন্ত রিপোর্ট ও বিচারপতি বর্মার ব্যাখ্যা সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। দিল্লি হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি উপাধ্যায় তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছেন, এই বিষয়ে গভীরতর তদন্তের প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। রিপোর্টে তিনি জানিয়েছেন, ১৫ মার্চ, হোলির ছুটির সময়ে দিল্লির পুলিশ কমিশনার সঞ্জয় অরোরা তাঁকে জানান, ১৪ মার্চ দিল্লির ৩০ নম্বর তুঘলক ক্রেসেন্টে বিচারপতি বর্মার সরকারি বাংলোয় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। সেখানকার ছবি-ভিডিয়োও তাঁকে পাঠান অরোরা। তাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলোর স্টোর রুমে তিন-চারটি বস্তায় ভরা আধপোড়া নোট রয়েছে। ওই স্টোর রুমে বাংলোর বাসিন্দা, পরিচারক, মালি বা বাংলোর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় পূর্ত দফতরের কর্মীরা ছাড়া আর কারও যাওয়া সম্ভব ছিল না বলে প্রাথমিক তদন্তের পরে ধারণা বিচারপতি উপাধ্যায়ের। বিচারপতি উপাধ্যায় জানিয়েছেন, বিচারপতি বর্মা তাঁকে জানান অগ্নিকাণ্ডের সময়ে তিনি ভোপালে ছিলেন। মেয়ের কাছ থেকে তিনি ঘটনার কথা জানতে পারেন। অন্য দিকে তাঁর ব্যাখ্যায় বিচারপতি বর্মা জানিয়েছেন, তাঁর বা তাঁর পরিবারের সদস্যেরা কেউ স্টোর রুমে নগদ জমিয়ে রাখেননি। ওই নগদ আদৌ তাঁদের নয়। বস্তুত এই ধারণাই একেবারে অযৌক্তিক বলে দাবি করেছেন তিনি। বিচারপতি বর্মার কথায়, ‘‘সহজে যাওয়া যায় এবং অনেকে ব্যবহার করেন এমন স্টোর রুমে কেউ নগদ জমিয়ে রাখবেন, এই ধারণাটাই অবাস্তব। ওই স্টোর রুম ও আমার বসবাসের স্থান একেবারে আলাদা। মাঝে রয়েছে পাঁচিল। সংবাদমাধ্যম আমার নামে অভিযোগ ও আমার মানহানি করার আগে কিছুটা তদন্ত করলে ভাল করত।’’ সুপ্রিম কোর্ট সূত্রের ব্যাখ্যা, স্বচ্ছতা বজায় রাখতে এবং আদালতের উপরে মানুষের আস্থা ফেরাতেই বিচারপতি উপাধ্যায়ের রিপোর্ট ও বিচারপতি বর্মার ব্যাখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে।
সূত্রের খবর, প্রথমে সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম বিচারপতি বর্মাকে বদলির সুপারিশ করলেও শুক্রবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের সমস্ত বিচারপতিদের বৈঠক বসে। সেখানে সকলেই বলেন, শুধুমাত্র বদলি করাটা যথেষ্ট নয়। বিচারপতির বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ করতে হবে। তার পরেই অন্তর্তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। প্রধান বিচারপতি বাকিদের বলেন, তদন্তের নিরপেক্ষতার স্বার্থেই প্রাথমিক ভাবে বদলির সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আর যা যা করা দরকার, সবই করা হবে। বদলির সুপারিশে অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকার এখনও সিলমোহর দেয়নি। সুপ্রিম কোর্টের আজকের সিদ্ধান্তকে সঞ্জয় হেগড়ে থেকে প্রশান্ত ভূষণের মতো প্রবীণ আইনজীবীরা স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, সুপ্রিম কোর্ট এ বার অন্তত স্বচ্ছতা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শুক্রবারই সংসদে বিচারপতি বর্মার বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধারের প্রসঙ্গ উঠেছিল। সেখানে বিচারপতি নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। শিবসেনা (উদ্ধব ঠাকরে)-র রাজ্যসভা সাংসদ প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদী এ বিষয়ে আজ প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। কারণ তিনি যখন ইলাহাবাদ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন, সে সময়ই বিচারপতি যশবন্ত বর্মাকে ইলাহাবাদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। পরবর্তী কালে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় যখন সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের সদস্য, সে সময় বিচারপতি বর্মাকে দিল্লিতে বদলি করা হয়। চতুর্বেদীর মন্তব্য, ‘‘প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির উত্তরাধিকার খুব তাড়াতাড়ি খোলসা হচ্ছে। হয়তো তিনি যা ভেবেছিলেন, তার আগেই।’’
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ফের বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে নয়া ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। আজ তৃণমূল সাংসদ তথা দলের জাতীয় মুখপাত্র সাকেত গোখেল মন্তব্য করেছেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামে আরও স্বচ্ছতা আনতে হবে এ কথা ঠিক। তবে বিচারপতি নিয়োগে কেন্দ্রীয় সরকারের নাক গলানোটাও ঠিক নয়। মোদী সরকার এমনিতেই মরিয়া হয়ে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। তা কোনও ভাবেই হতে দেওয়া যায় না।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)