জামা মসজিদের সামনে সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, জামায়েত। ফাইল চিত্র।
‘‘কার দিকে ইশারা করলেন আপনি? না, কথা বলা যাবে না এ ভাবে। আপনার অন্যান্য পরিচয়পত্র দেখান।’’
বিকেল গড়িয়ে যাওয়া আলোয় মায়াময় দেখাচ্ছে জামা মসজিদের ইতিহাসপ্রাচীন সিঁড়িগুলো। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকা পর্যটক এবং প্রেমিক-প্রেমিকাদের ধাপে ধাপে পার হয়ে উঠলে প্রধান ফটক। তার ঠিক সামনেই জাতীয় পতাকা। সঙ্গে স্লোগান, গান, ধর্না, পোস্টার। প্রায় এক মাস ধরে রোজ এই জমায়েত ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের। তবে এই জমায়েত কিছুটা সন্দেহ এবং অনেকটা আশঙ্কায় কিছুটা কাবুও। তা না-হলে, সাংবাদিকের পরিচয়পত্র দেখিয়ে সিঁড়িতে বসে কথাবার্তা নোট করার মধ্যে এক বার অভ্যাসমাফিক হাত ঝাঁকাতেই এতটা অবিশ্বাস তৈরি হবে কেন?
‘‘আমাদের বাড়ি পুলিশ এসেছে। আমাদের ধর্না নিয়ে খোঁজখবর করে গিয়েছে। তার পরে এই সিঁড়িতে রাখা ব্যাগ থেকে বেছে বেছে ভোটার আইডি চুরি করা হয়েছে। সরাসরি জমায়েত তুলে নিতে বলছে না বটে, কিন্তু নজর রাখা হচ্ছে। এখন কাউকেই বিশ্বাস করা না-মুমকিন!’’ একটু শান্ত হওয়ার পরে জানাচ্ছেন জন্নত ফারুকি। দুপুর ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত লাগাতার ধর্নার প্রধান উদ্যোক্তা এই জন্নত বলছেন, ‘‘সিএএ, এনআরসি আর এনপিআর যোগ করুন। ফলাফল দাঁড়াচ্ছে, ডিভাইড অ্যান্ড রুল। অমিত শাহ বার বার বলছেন, এই আইন নাকি নাগরিকত্ব নেওয়ার নয়, দেওয়ার। নতুন করে নাগরিকত্ব দেওয়ার তিনি কে? বিদেশ থেকে কেউ এসে নির্দিষ্ট সময়ের পরে আবেদন করলে নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা
আগের আইনেই ছিল। হঠাৎ কী এমন ঘটল যে, সংবিধান সংশোধন করতে হচ্ছে?’’ উত্তরটাও দিলেন তিনিই। ‘‘বাপ-চাচার পরিচয়পত্র ওদের শর্তে দেখাতে না-পারলেই আমাদের তারজালির পিছনে ঢোকাবে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে।’’
চাঁদনি চক, বল্লিমারান, চাওড়ি বাজার হয়ে জামা মসজিদ পর্যন্ত হেঁটেও এগোনো মুশকিল, রাস্তা এতটাই ঘিঞ্জি। গোটা রাস্তায় বিজেপির একটিও পোস্টার বা গেরুয়া পোস্টারে ঢাকা অটো চোখে পড়ে না। এমনকি, আম আদমি পার্টির উপস্থিতিও কম। ভোটের উৎসব কিছুটা থমকেই রয়েছে পুরনো দিল্লিতে। অথচ আট মাস আগে লোকসভা ভোটের সময় এসে দেখেছি, এই গলিঘুঁজিতে মাইক লাগানো বিজেপি-শোভিত অটো ঘুরছে।
জামা মসজিদের সিঁড়ির মতামত, গত পাঁচ বছর আম আদমি পার্টি ভাল কাজ করেছে ঠিকই। কিন্তু সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৈয়দ অহমেদ বলছেন, ‘‘আম আদমি পার্টি নিজেদের ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে গা বাঁচিয়ে চলছে।’’ তবে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-বিরোধী ভোট যাতে ভাগ না-হয়, সে-দিকেও নজর রাখছেন তাঁরা। ‘নোটা’-য় ভোট দেওয়ার ভাবনাচিন্তাও রয়েছে।
তবে সিঁড়ি গিয়ে নেমে যে ‘দিল্লি সিক্স’, সেখানে আপ ছাড়া কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তেলেভাজা, রুহ আফজা, কাবাব, ভাল্লা পাঁপড়ি — সব মিলিয়ে প্রাচীন গন্ধ। চশমা, কাঁচের চুড়ি, চপ্পল আর বিয়ের কার্ডের দোকানে ঠাসা। ‘‘শুধু গত কয়েক মাসই নয়, আপ বিধায়ক ইমরান হুসেন সব সময় আমাদের সঙ্গে আছেন। মাঝেমধ্যেই এসে দোকানে ঢুকে পড়েন সাঙ্গোপাঙ্গ ছাড়াই’’ বললেন শফিকুল রহমান। নোটবন্দিতে যা চোট পেয়েছিলেন, তার ক্ষত এখনও শুকোয়নি। বলছেন, ‘‘গোটা দেশে পাইকারি ব্যবসা করি। তাই জিএসটি-তে আমাদের তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু ঘরের অওরতদের যা পুঁজি জমানো ছিল, সব খালি হয়ে গিয়েছে।’’
স্থানে স্থানে রাস্তাঘাট প্রায় নরক। স্থানীয় দোকানদারেরা বলছেন, পুরনো হয়ে যাওয়া নালা-নর্দমা ফেটে জল উপচে পড়ে মাঝেমধ্যেই পূতিগন্ধময় হয়ে যায় গোটা এলাকা। ‘‘কারও কোনও হেলদোল নেই। এমনিতেই এই ডিজিটাল যুগে বিয়ের কার্ড ব্যাপারটাই উঠে যাচ্ছে। তার মধ্যে দোকানের সামনে এই দুর্গন্ধ,’’ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতটা বিরক্ত ‘নবরতন ওয়েডিং কার্ড’-এর মালিক আর কে জৈন। পাশাপাশি অন্তত গোটা বারো কার্ডের দোকান একই ভাবে মাছি মারছে। ‘‘নোটবন্দি যখন হয়েছিল। তখন ভরা বিয়ের মরসুম। লোকের হাতে সেই সময় বিয়ে করার টাকাই নেই তো কার্ডের অর্ডার দেবে কি! সেই যে শুরু হল হোয়াটসঅ্যাপে নেমন্তন্ন, এখনও সেটাই চলছে।’’
সিপাহী বিদ্রোহের পরে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া মির্জা গালিব, দিল্লির ভাঙন দেখতে দেখতে এক দিনলিপি লিখেছিলেন (দস্তাম্বু)। দিল্লির পতনে বিষণ্ণ কবি বলেন, ‘কেল্লা, চাঁদনি চক, গিরিন্দা বাজার, জুম্মা মসজিদ —প্রতি সপ্তাহে যমুনার পুলে যাওয়া, প্রতি বছর ফুলওয়ালাদের মেলা। এই পাঁচ-পাঁচটি জিনিসই যখন নেই, তখন বলো দিল্লি শহরটা কোথায়?’
নাকে রুমাল চেপে চাউড়িবাজার থেকে বেরোনোর সময় দেড়শো বছরেরও পুরনো লাইনগুলো কেমন যেন সামনে চলে এল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy