Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Nitish Kumar

দিন চলে না, তবু নীতীশই ভরসা দলিতদের

বেঁচে থাকাটাই যেখানে লড়াই, সেখানে হাথরস নিয়ে কে মাথা ঘামায়।

নীতীশ কুমার। ফাইল চিত্র।

নীতীশ কুমার। ফাইল চিত্র।

অনমিত্র সেনগুপ্ত 
মুজফফরপুর শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২০ ০৫:১১
Share: Save:

“হাথরসের ঘটনা জানেন!” পাঁক-ভর্তি পায়ে টুকরো শ্যাওলা। মাথায় কার্তিকের সূর্যের তেজ। চরাচর-বিস্তীর্ণ বন্যার জমা জলে জাল টানতে টানতে মুহূর্তের জন্য থমকালেন বীরেন্দ্র মাঝি। পাল্টা প্রশ্নে জানতে চাইলেন, ‘‘সে আবার কোথায়?’ উত্তরপ্রদেশ শুনেই মুখ ঘুরিয়ে মুখের আধপোড়া বিড়িতে এক টান দিয়ে ফের জাল টানায় মন দিলেন। অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘‘রাজ্যের খবরই জানি না। ভিন্ রাজ্যে কী হচ্ছে, কী করে বলব!’’

বিহারের সামাজিক সিঁড়িতে অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বা একস্ট্রা ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের (ইবিসি) মধ্যে মহাদলিত শ্রেণির প্রতিনিধি বীরেন্দ্র, নরেশ-সহ জনা দশেকের ভিড়ের কাছে হাথরস তো অনেক দূর, ভোট-মরসুমে ঘরের পাশে বক্সারে অত্যাচার করার পরে দলিত মহিলাকে যে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে খবরও অজানা। নরেশের কথায়, ‘‘কী করে পেট ভরাব, বাচ্চাগুলোকে কী খেতে দেব, তা ভাবতেই দিন চলে যায়। বাকি কিছুর সময় কোথায়।’’

মুজফফরপুর ও বৈশালী জেলার সীমানায় অবস্থিত সাজন গঙ্গারামটোলার কয়েক ঘর মাঝি শ্রেণির পরিবার গত ছ’মাস অস্থায়ী ঘর বেঁধেছেন রাজ্য সড়কের দু’পাশে। নেপাল থেকে ছাড়া বন্যার জল সেই যে খেতে ঢুকেছে, নামার কোনও লক্ষণই নেই। রাজ্যের অন্য প্রান্তের মতো এখানেও ভোটের দামামা বেজেছে ঠিকই, কিন্তু ভোট চাইতে এখনও আসেনি কেউ। বোচহান কেন্দ্রের নির্দল বিধায়ক বেবি সিংহের গাড়ির মিছিল দিনরাত ছুটছে রাজ্য সড়কের উপর দিয়ে। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে বীরেন্দ্র-মহেশদের হাল জানার ফুরসত মেলেনি বিধায়কের।

আরও পড়ুন: কীসের জন্য ক্ষমা চাইব? পুলওয়ামা বিতর্কে প্রতিক্রিয়া তারুরের​

আরও পড়ুন: তারকা প্রচারকের তকমা হারিয়ে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে কংগ্রেস নেতা কমল নাথ​

বন্যায় ক্ষতিপূরণ মেলে শুনেছেন, কিন্তু সে সব চোখে দেখেননি। ইন্দিরা আবাস যোজনায় পাকা বাড়ি করে দেওয়ার জন্য গ্রামপ্রধান নাম লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাটমানি জোগাতে না-পারায় সেই টাকা হাতে আসেনি। যদিও খাতায়-কলমে টাকা নাকি তাঁরা পেয়েছেন! সরকারি সাহায্য বলতে শুধু রেশনের নিম্নমানের চাল-গম। সঙ্গে কুঁচো মাছ আর শাক। বেঁচে থাকাটাই যেখানে লড়াই, সেখানে হাথরস নিয়ে কে মাথা ঘামায়।

তবে এত নিরাশার মধ্যেও ভোটটা নীতীশের দলকেই দেবেন মহেশ। তাঁর যুক্তি, “নীতীশের দলের হয়ে লড়ছেন জীতনরাম মাঝি। আমাদের জাতের লোক। তিনি যেখানে বলবেন, সেখানেই আমাদের ভোট যাবে।” হাওয়া বুঝে ভোটের ঠিক আগে জীতন মাঝির হিন্দুস্থান আওয়াম মোর্চা (হাম)-কে এনডিএ-তে সামিল করিয়েছেন নীতীশ। লক্ষ্য মাঝি, নিশাদ, ধোবি, পাসি সমাজের ভোট।

সালটা ২০২০ হলেও, বিহারের ভোট-রাজনীতি এখনও নিয়ন্ত্রণ করে জাতপাতই। ২০০৫ সালে ক্ষমতায় এসে নীতীশ উন্নয়নের নামে ভোট চাওয়ার দাবি করেছিলেন বটে, কিন্তু তলেতলে জিইয়ে রেখেছেন জাতপাত। জেডিইউয়ের নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক গড়তে কুর্মি সমাজের প্রতিনিধি নীতীশ প্রথমে ওবিসির নিচে ইবিসি বলে আলাদা একটি শ্রেণি গড়েন। পরবর্তী ধাপে দলিত ভোটে রামবিলাস পাসোয়ানের পরিবারের একচেটিয়া আধিপত্য ভাঙতে ২০০৯ সালে গঠন করেন মহাদলিত শ্রেণি। নীতীশের যুক্তি ছিল, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুর ১৯৭৮ সালে যে মুঙ্গেরিলাল কমিশন গঠন করেছিলেন, তার সুপারিশ মেনেই নতুন শ্রেণিবিন্যাস করেছেন তিনি।

আরজেডি-র আমলে যাদব শ্রেণির বাড়বাড়ন্ত দেখে মহাদলিত শ্রেণি এসে ভিড় করে নীতীশের ছাতার তলায়। বর্তমানে ইবিসি (২৪ শতাংশ), দলিত (৬ শতাংশ) এবং মহাদলিত (১০ শতাংশ) মিলিয়ে রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ। যাঁরা তফশিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত ৩৮টি আসন ছাড়াও আরও প্রায় ৬০টি আসনে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। এই ভোটব্যাঙ্ক আগলে রাখতে ইবিসি, দলিত, মহাদলিতদের উন্নয়নের জন্য একাধিক কমিশন গঠন করেছেন নীতীশ। যদিও তাঁর ১৫ বছরের শাসনে এঁদের উন্নয়ন কতটা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের খতিয়ানে স্পষ্ট, নিজের লক্ষ্যে সফল নীতীশ। সে বার পিছিয়ে থাকা সমাজের অন্তত ৬৩ শতাংশ ভোট পায় এনডিএ। তখন অবশ্য পাসোয়ানের দল এলজেপি এনডিএতে ছিল। ফলে ভোট ভাগাভাগি কম হয়েছিল।

নীতীশের দলের সাংসদ রাজীবরঞ্জন সিংহের কথায়, ‘‘এ বার চিরাগ দলিত ও পাসোয়ান ভোট কিছুটা কাটবেন ঠিকই, তবু পিছিয়ে থাকা সমাজের অন্তত ৫০-৫৫ শতাংশ ভোট এনডিএ পাবে বলেই আশা।’’ নীতীশ যেমন উত্তর বিহারে জীতনরামকে সামনে রেখে এগোচ্ছেন, তেমনই বিজেপির তুরুপের তাস হলেন মুকেশ সাহানি। গয়া-জহানাবাদের মতো দক্ষিণ বিহারে নীতীশের জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী হওয়ায়, পিছিয়ে থাকা শ্রেণির ভোট আদায়ে মুকেশের সদ্যগঠিত বিকাশশীল ইনসান পার্টি (ভিআইপি)-কে টিকিট দিয়েছে বিজেপি।

তবে নীতীশ-বিরোধী হাওয়া সিঁধ কেটেছে সমাজের নিচু তলাতেও। বোচহা বিধানসভার গৌরিটোলা এলাকার বাসিন্দা মুশাফির হাজারি গোড়া থেকেই নীতীশের তির চিহ্নে ভোট দিয়ে এসেছেন। কাজ করতেন বুড়ি গন্ডক নদীর অবৈধ বালি খাদানে। কিন্তু নীতীশ শেষ দফায় ক্ষমতায় এসে বালি তোলা বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে এক ধাক্কায় কাজ হারিয়েছেন মুশাফির, ছেলে মহেশ্বর, ভাই শঙ্কর-সহ ওই এলাকার প্রায় প্রতি ঘরের বাসিন্দা। মহেশ্বরের কথায়, “এক দিকে কাজ হারিয়েছি। অন্য দিকে, বালির দাম কার্যত চার গুণ বেড়ে গিয়েছে।’’ মদ বন্ধ নিয়েও প্রবল সরব মুশাফির-শঙ্কররা। মুশাফিরের কথায়, “বন্ধ করে কী লাভ হল! কালোবাজারে সবই তো পাওয়া যাচ্ছে। আমরা যারা কাজের শেষে একটু-আধটু খেতাম, তাদের দ্বিগুণ-তিন গুণ দামে কিনতে হচ্ছে। লাল হচ্ছে এক শ্রেণির পুলিশ।’’

তবু এ যাত্রাতেও নীতীশেই ভরসা রাখতে চান গৌরীটোলার মহাদলিত সমাজের বাসিন্দারা। তাঁদের মতে, নীতীশের আমলে যাদবদের দাদাগিরি ঠান্ডা হয়েছে। তেজস্বীর হাত ধরে আরজেডি ক্ষমতায় এলে যাদবদের হাতে ফের লাঠি উঠে আসা সময়ের অপেক্ষা। সেই কারণে প্রতিটি জনসভাতে নিয়ম করে ‘জঙ্গলরাজ’-এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন নীতীশ। অতীতকে উস্কে দিয়ে বর্তমানে কি সফল হতে পারবেন তিনি? সেটাই এখন দেখার।

অন্য বিষয়গুলি:

Bihar state assembly election Nitish Kumar Dalits
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy