ঘটা করে রামনবমী উদযাপনের ঘণ্টা বাজছে বাংলা জুড়ে। কলকাতা থেকে ২১২০ কিলোমিটার দূরের এক শহরে সেই সময়ে মিলে যাচ্ছে দুই কাঁসি-মাদলের শব্দ। মীনাক্ষী মন্দিরকে ঘিরে তামিলনাড়ুতে হিন্দুদের বড় উৎসব ‘চিতিরাই’ এই এপ্রিলেই। তার প্রস্ততিতে নানা ধর্মীয় শোভাযাত্রার মাঝে রাস্তা করে এগোচ্ছে সিপিএমের সুসজ্জিত মিছিলও। ‘শহিদ স্মরণে’ রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে আসা মশাল মিছিলও এক জায়গায় মিলে শেষ হল মঙ্গলবার সন্ধ্যায়।
তামিলনাড়ুর মন্দির শহর মাদুরাইয়ে সিপিএমের এ বারের পার্টি কংগ্রেস দেশ জুড়ে হিন্দুত্বের রাজনীতির আগ্রাসনের মোকাবিলার ডাক দিয়েই। পুরনো, ঘিঞ্জি শহরে দেবতার অর্চনায় শোভাযাত্রার পাশাপাশি গণ-দেবতার মন ফিরে পেতে সিপিএমের আয়োজন প্রতীকীই মনে হবে! বড় কোনও রাজধানী শহর বাদে মাদুরাই-ই একমাত্র জায়গা, যেখানে তিন বার (১৯৫৩, ১৯৭২ ও ২০২৫) পার্টি কংগ্রেস হচ্ছে। তার মধ্যেও বিশেষত্ব, একই সভাস্থলে ৭২ বছরে তিনটি পার্টি কংগ্রেস! একমাত্র কলকাতায় এর চেয়ে বেশি বার পার্টি কংগ্রেস হয়েছে— চার বার।
মীনাক্ষী মন্দিরে ‘চিতিরাই’ উৎসবের পতাকা উত্তোলন হওয়ার কথা আগামী ২৯ এপ্রিল। শহরের অন্য দিকে তাম্মুকম কনভেনশন সেন্টারে বুধবার পতাকা উঠবে সিপিএমের ২৪তম পার্টি কংগ্রেসের। উত্তোলনের দায়িত্বে দলের বর্ষীয়ান নেতা বিমান বসু। রামনবমী ঘিরে কী হয়, কী হয় ভাবের জন্য মাদুরাইয়ে এসে বাংলার সিপিএম নেতাদের যেমন নিজেদের রাজ্যের খোঁজ রাখতে হচ্ছে, তেমনই আবার সিপিএমের নজর আটকে রয়েছে বাংলায়। দলের পলিটব্যুরো কো-অর্ডিনেটর প্রকাশ কারাটের মতে, বাংলা ও ত্রিপুরায় নির্বাচনী ময়দানে বামেরা ধাক্কা খাওয়ায় দলের শক্তি বিপুল ভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাংলায় দলের পুনরুজ্জীবন না ঘটলে শক্তি ফিরবে না এবং সেটা না-হলে আরএসএস-বিজেপির সঙ্গে টক্কর নেওয়ার তাকতও বাড়বে না। বাংলায় তাই নজর দিতেই হবে।
এরই পাশাপাশি এম কে স্ট্যালিনের রাজ্যে অন্য এক অভিনব পথে হাঁটছে সিপিএম। হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াসের বিরুদ্ধে রীতিমতো জেহাদ ঘোষণা করেছেন স্ট্যালিন। তাঁরই জোটসঙ্গী সিপিএম এ বার প্রেক্ষাগৃহে পার্টি কংগ্রেসের যাবতীয় আলোচনা ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা, তামিল ও মালয়ালমে অনুবাদের ব্যবস্থা রাখছে। যা এ বারই প্রথম। মাদুরাইয়ের সিপিএম সাংসদ সু বেঙ্কটেশনের কথায়, ‘‘ভাষাগত কোনও আধিপত্যবাদ এই বহুত্বের দেশে চলে না, এই বার্তাই আমরা দিতে চাই।’’
কনভেনশন সেন্টার লাগোয়া ময়দানে কাল, বৃহস্পতিবার রাজ্যগুলির অধিকার সংক্রান্ত আলোচনায় থাকার কথা তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন, কেরলের মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন, কর্নাটকের কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী কৃষ্ণ বায়ার গৌড়া ও কারাটের। ওই ময়দানেই ‘শহিদ স্মরণে’ মশাল মিছিলকে স্বাগত জানিয়ে সন্ধ্যায় দলের পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাট বলছিলেন, ‘‘আমাদের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলতেন, দু’টো পায়ের উপরে কমিউনিস্ট পার্টি দাঁড়িয়ে থাকে। এক পা পুঁজিবাদী অর্থনীতির শোষণ এবং আর একটা পা সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে এগোয়। সেটাই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে।’’
এই পার্টি কংগ্রেস আসলে সিপিএমের নিজের পায়ের জোর খোঁজার আসর!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)