আনুষ্ঠানিক ভাবে পার্টি কংগ্রেসের আসরে সিলমোহর পড়ার আগে যে রাতে বিদায়ী পলিটব্যুরোর ‘দ্বন্দ্বমূলক’ বৈঠকে তাঁর নাম দলের শীর্ষ পদের জন্য ঠিক হল, সে দিন ছিল জন্মদিন! বলতে গেলে জন্মদিনের উপহার তাঁকে দিয়েছে সিপিএম। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা তো বটেই, অভিনেতা কমল হাসন থেকে শুরু করে শিল্প ও সংস্কৃতি জগতের বেশ কিছু প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন। পার্টি কংগ্রেস শেষ হয়ে যাওয়ার পরের দিন সকালে মাদুরাই শহরে পি রামমূর্তির (সিপিএমের প্রতিষ্ঠাতা ‘নবরত্নে’র অন্যতম এবং মাদুরাই থেকে লোকসভায় এক সময়ের সাংসদ) মূর্তিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে নতুন ইনিংস শুরু করলেন মারিয়ম আলেকজ়ান্ডার বেবি। কঠিন সময়ে দলের দায়িত্ব পেয়ে শক্ত পরীক্ষার মুখে যে তাঁকে পড়তে হবে, মেনে নিচ্ছেন সিপিএমের নতুন সাধারণ সম্পাদক। বলছেন, পূর্বসূরিদের দেখানো পথই তাঁর ভরসা!
বেবির কথায়, ‘‘দল যে দায়িত্ব দিয়েছে, এক জন অনুগত কর্মী হিসেবে সেটা স্বীকার করেছি। এই দায়িত্বের সঙ্গে অনেক চ্যালেঞ্জ অবশ্যই আছে। সেগুলোর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। দেশ জুড়ে দলের প্রায় ৯ হাজার শাখাকে সক্রিয় করে আন্দোলনে গতি আনতে হবে। জাতীয় রাজনীতিতে বামেদের কথা যাতে গুরুত্ব দিয়ে শোনা হয়, সেই জায়গা আবার তৈরি করতে হবে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘সেই ১৯৭০-এর দশকে ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করেছিলাম। তার পরে যুব আন্দোলন, সংসদীয় রাজনীতির ভিতরে ও বাইরে কাজ করেছি। সব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। আমাদের দলে সমষ্টিগত ভাবে কাজ হয়। আগের নেতারা যা দেখিয়ে গিয়েছেন, সেই দৃষ্টান্ত থেকে শেখার চেষ্টা করব।’’
সিপিএমে সাধারণ সম্পাদকের এক বারের মেয়াদ তিন বছর। এখনও পর্যন্ত যা পরিকল্পনা আছে, তাতে বেবি দুই মেয়াদে ওই পদে থাকতে পারবেন। তবে প্রাথমিক ভাবে তাঁর পরীক্ষার আগে সময় হাতে এক বছর! আগামী ২০২৬ সালেই কেরল ও বাংলা, বাম রাজনীতির জন্য দুই গুরুত্বপূর্ণ বড় রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। কেরলে লড়াই ফের সরকার বাঁচিয়ে একমাত্র বাম ‘মরূদ্যান’ ধরে রাখার। আর বাংলায় লড়াই শূন্য থেকে উঠে দাঁড়ানোর!
নিজের রাজনৈতিক জীবনে কেরলে হাতে-কলমে কাজ করেছেন বেবি। দক্ষিণী ওই রাজ্য থেকে রাজ্যসভায় গিয়েছেন, রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছেন। আবার ছাত্র ও যুব রাজনীতির সময় থেকেই বাংলায় তাঁর যাতায়াত। দলের সাধারণ সম্পাদক হয়ে তিনি মেনে নিচ্ছেন, ‘‘মানুষের জন্য আমরা যদি কাজ করে থাকি, কেরলে আবার বাম সরকার অবশ্যই গড়া সম্ভব। আর বাংলা ও ত্রিপুরা, এই দু’টো রাজ্যেই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন দলের কর্মীরা। সেখানেও দলের শক্তি বাড়াতে হবে।’’ সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরে প্রথম দিনে মাদুরাই থেকে বিকালে সোজা তিরুঅনন্তপুরমে কেরল সিপিএমের রাজ্য দফতরেই গিয়েছেন বেবি।
বাংলায় গত কয়েক বছরে ছাত্র ও যুবদের দেখা যাচ্ছে আন্দোলনের সামনের সারিতে। কিন্তু রাজ্যে দলের সদস্য-সংখ্যার মাত্র ৮% এখন তরুণ প্রজন্মের (নির্দিষ্ট বয়সের সীমার মধ্যে)! এই পার্টি কংগ্রেসে বাংলায় বাম রাজনীতি ও সংগঠনের এই বৈপরীত্য নিয়েই সব চেয়ে বেশি চর্চা হয়েছে। আন্দোলনে আসা যুব প্রজন্মকে দলের সংগঠনে টেনে নিয়ে আসার বার্তা দিতেই যুব নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে এত দ্রুত কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছে। দলের বিদায়ী রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘আম জনতার বড় অংশকে আকৃষ্ট করতে পারবে, সেই রকম আন্দোলনে আমাদের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। সেই কারণেই সংগঠনে আরও বেশি অংশের প্রতিনিধিদের টেনে আনা যাচ্ছে না। ’’ বেবিও জানাচ্ছেন, সংগঠনের দুর্বলতা তাঁরা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। এই পরিস্থিতিতে কলকাতায় ব্রিগেড সমাবেশের পরের দিন, ২১ এপ্রিল সিপিএমের নতুন রাজ্য কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)