সুব্রত মুখোপাধ্যায়, বাবুল সুপ্রিয় ও সোমেন মিত্র।—ফাইল চিত্র।
কারও ‘অস্থির-অস্থির’ লাগছিল। কেউ আবার সে অস্থিরতা সহ্য করতে না পেরে ঘর ছেড়ে কিছুক্ষণের জন্য রোজ বেরিয়েও পড়ছিলেন। তবে রাজনৈতিক হেভিওয়েটদের মধ্যে এমনও কেউ কেউ এমনও রয়েছেন, যাঁরা বলছেন, সময় কাটাতে অসুবিধা তো হচ্ছেই না, বরং সময়টা কাজে লেগে যাচ্ছে।
ঘরে থাকাটা এখন বাধ্যতামূলক। কিন্তু এঁদের ক্ষেত্রে ঘরে থাকা মানে কিন্তু করোনা বিরোধী যুদ্ধটা থেকে দূরে থাকা নয়। ঘরই এখন দফতর হয়ে উঠেছে, ঘর থেকেই চলছে সমন্বয়। আচমকা ঘরে আটকে পড়েছে গোটা দেশ আর বাইরে ছড়াচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর রোগ। সুতরাং এক দিকে রোগের মোকাবিলার বন্দোবস্ত করা, অন্য দিকে কাজকর্মহীন দশায় গৃহবন্দি হওয়া কোটি কোটি নাগরিক যাতে দুর্গতির মুখে না পড়েন, তা নিশ্চিত করা। এই দুটো কাজ একসঙ্গে সামলাতে হচ্ছে রাজনীতিক তথা মন্ত্রীদের। প্রত্যেকেই বলছেন, কাজের চাপ সাধারণ পরিস্থিতির চেয়ে বেশি। আবার সারাদিন ঘরে থাকার সুবাদে জীবনের অনেক থমকে যাওয়া স্রোতও কিন্তু নতুন করে বইতে শুরু করেছে বছরভর ব্যস্ত থাকা এই রাজনৈতিক রথী-মহারথীদের জীবনে।
রাজ্যের মন্ত্রিসভায় সবচেয়ে প্রবীণদের একজন তিনি। অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক হিসেবে পরিচিতও রয়েছে তাঁর। কলকাতার মেয়র হিসেবে কাজ করার সময়ে হোক বা পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী হিসেবে বর্তমান ভূমিকায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কাজ সব সময়েই প্রশংসিত। লকডাউনের জেরে একডালিয়ার বাড়িতে সেই ‘কাজের মানুষ’টি গৃহবন্দি। কিন্তু এই সঙ্কটের সময়ে তাঁর হাতে থাকা দফতরের গুরুত্বও প্রবল। পঞ্চায়েতগুলোকে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে করোনা মোকাবিলায়। লকডাউন আরও কিছু দিন গড়ালে এই পঞ্চায়েতগুলোকে কাজে লাগিয়েই আরও বেশি করে দাঁড়াতে হবে গ্রামীণ জনতার পাশে। তার প্রস্তুতিও রাখতে হচ্ছে। সুতরাং সুব্রত এখনও যথেষ্টই ব্যস্ত। কিন্তু ঘরে থাকার সুবাদে প্রিয় ইজিচেয়ারটায় বসে বই পড়ার সুযোগটাও কয়েক দিন হল ফিরে এসেছে। ট্রেনারকে ছুটি দিয়ে একা একাই ব্যায়ামটাও চালিয়ে যাচ্ছেন রোজ।
আরও পড়ুন: লকডাউন নিশ্চিত করতে সীমানা সিল করুন, রাজ্যগুলিকে নির্দেশ কেন্দ্রের
‘‘প্রথম ক'দিন খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। ভাবছিলাম কী করে এতক্ষণ ঘরে থাকব! একটু বেরিয়েও পড়ছিলাম। আমার ক্লাবটায় গিয়ে দু'তিন ঘণ্টা একটু গল্প করে আসছিলাম।’’ বললেন সুব্রত। একটু হেসে যোগ করলেন, ‘‘দূরত্ব বজায় রেখেই গল্পগুজব চলছিল। কিন্তু তার পরে দেখলাম যে, ঘরে থাকতেই হবে। সেটা সবার জন্যই জরুরি।’’ আর এই ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে গিয়েই বহু দিনের একটা প্রিয় অভ্যাসকে ফিরে পেয়েছেন রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী। বললেন, ‘‘আমার একটা ইজিচেয়ার আছে। বাড়ির রাস্তাটায় সেটা পেতে বসে বই পড়তে একটা সময়ে খুব ভালবাসতাম। কয়েক দিন হল, কিছুটা সময়ের জন্য সেই অভ্যাসটা ফিরে পেয়েছি।’’ সুব্রতর কথায়, ‘‘বাড়িতে তো থাকাই হয় না। তাই বইপত্রগুলোয় হাত দেওয়ার সুযোগও কম। এখন একটু বইগুলো আবার ঘাঁটতে পারছি। কয়েকটা নতুন বই পড়তে পারছি।’’ আর কী করছেন? ‘‘আর একটু গল্প করছি পরিবারের লোকজনের সঙ্গে, একটু হয়তো গান শুনছি। খবরটায় চোখ রাখছি। আর ব্যায়ামটা খুব মন দিয়ে করছি।’’
বছরভর যে দৌড়ঝাঁপ চলে মন্ত্রীর, তার সুবাদে শারীরিক কসরৎ অনেকটাই হয়। তাই সে সময়ে ট্রেনারের সঙ্গে কিছুটা ওয়ার্ক আউট করে নিলেই মিটে যায়। লকডাউনের জেরে সুব্রতর সে দৌড়ঝাঁপ এখন বন্ধ। ট্রেনারকেও ছুটি দিয়ে রেখেছেন। তাই নিজেই একটু কসরৎ বাড়িয়ে নিয়েছেন। স্বভাবসিদ্ধ মুচকি হেসে বললেন, ‘‘রোজ বেশ কিছুটা সময় ব্যায়াম করছি। আর সেটাও ট্রেনারকে ছাড়াই করছি।’’
রাজ্যের অন্যতম প্রবীণ মন্ত্রীর বাড়িতে যে ছবি, কেন্দ্রের অন্যতম নবীন মন্ত্রীর অন্দরমহলও অনেকটা তেমনই এই মুহূর্তে। দিল্লির বাংলোয় বসেই গোটা দেশে নিজের মন্ত্রকের নানা কাজের সঙ্গে সমন্বয় রাখছেন বাবুল সুপ্রিয়। আর লকডাউনের জেরে তাঁর নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্র আসানসোলে কোথায় কে কী রকম সমস্যায় রয়েছেন, সে খোঁজও নিরন্তর নিচ্ছেন এবং সুরাহার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন। বিজেপি এবং যুব মোর্চার স্থানীয় নেতৃত্বকে রাস্তায় নামিয়েছেনা বাবুল। আসানসোল শহরে তো বটেই, তার বাইরে বারাবনি, কুলটি, জামুড়িয়া, রানিগঞ্জের বিভিন্ন নিম্নবিত্ত এলাকায় পৌঁছে গিয়েছেন তাঁরা। ‘‘খাদ্যসামগ্রীর প্রায় শ'পাঁচেক প্যাকেট ইতিমধ্যেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আর কোথায় কোথায় পৌঁছনো দরকার, তার তালিকাও তৈরি হচ্ছে।’’ বললেন আসানসোল থেকে পর পর দু'বার নির্বাচিত হওয়া সাংসদ। আর জানালেন যে, এই সবের ফাঁকে একটু গান, পরিবারকে নিয়ে একটু গল্পগুজব, কোনও একটা পদ নিজের হাতে রেঁধে সবাইকে খাওয়ানো আর শখের গার্ডেনিং-ও বেশ চলছে।
আরও পড়ুন: রাজ্যে ফের এক জন করোনা-আক্রান্ত, এ বার কম্যান্ড হাসপাতালের চিকিৎসক
রাজনীতিতে অনেক পরে এসেছেন বাবুল। গায়ক হিসেবেই বিখ্যাত হয়েছিলেন প্রথমে। সুতরাং মন্ত্রিত্ব সামলাতে গেলে গানকে বিসর্জন দিতে হবে, এমনটা কখনও ভাবেননি। গানের চর্চা বা নতুন গান নিয়ে কাজ তাঁর বছরভরই চলে। কিন্তু অন্য সময়ে বাড়িতে তাঁর থাকাই হয় কম। আর এখন লকডাউনের জেরে পুরোটা সময়ই কাটছে ঘরে। সুতরাং গানকে আর একটু বেশি সময় দিয়ে পারছেন। রোজই একটু ফাঁক খুঁজে হারমোনিয়ামটা টেনে নিচ্ছেন কোলের কাছে।
সকন্যা গানে বাবুল।—নিজস্ব চিত্র
গানের সময়ে বাবুল অবশ্য একা থাকছেন না। বাবা গান গাইতে বসলেই এক গাল হেসে হাজির হচ্ছে বাবুলের ছোট্ট মেয়ে। কখনও বাবার কাঁধে চেপে গান শুনছে, কখনও পাশে বসে তাল দিচ্ছে, কখনও আবার মেয়েকে গাইতে দিয়ে বাবা হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন।
লকডাউনে মন্ত্রীর মেয়ে যেমন বাবার সঙ্গে একটু বেশি সময় কাটাতে পারছে, ঠিক তেমন ‘সৌভাগ্য’ কিন্তু মন্ত্রীর নিজেরও হয়েছে। ‘সৌভাগ্য’ শব্দটা নিজেই ব্যবহার করলেন বাবুল। বললেন, ‘‘সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবা-মা-ও এখন দিল্লিতে আমার সঙ্গেই রয়েছেন। সারা দিন যতই ব্যস্ততা যাক, বাড়িতেই তো আছি। অনেক দিন পরে আবার বাবা-মায়ের সঙ্গে রোজ একটু সময় কাটাতে পারছি।’’ মাঝেমধ্যে নিজের হাতে রান্না করে সবাইকে খাওয়ানো আর বাড়ির ফুলের বাগানের পরিচর্যা করাও যে তাঁর খুব প্রিয় কাজ, তা-ও নিজেই জানাচ্ছেন মন্ত্রী। কানে ইয়ারপড গুঁজে দরকারি কাজ সামলানোর ফাঁকে সেই সব প্রিয় কাজগুলোকেও এখন একটু সময় দিতে পারছেন মন্ত্রী।
আরও পড়ুন: করোনা সঙ্কটে অবসাদ! আত্মঘাতী জার্মান মন্ত্রী, রেললাইনে দেহ
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র আবার ডুব দিয়েছেন রবীন্দ্রসংগীতে। পুরোটা ডুব দেওয়ার সুযোগ নেই। করোনা সঙ্কটের মোকাবিলায় এবং লকডাউনের সময়ে আর্থিক ভাবে দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দলকে যতটা বেশি করে সম্ভব কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। রাজ্যের নানা প্রান্তের কংগ্রেস বিধায়কদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সে সবের ফাঁকেই মাঝে মাঝে ডুবে যাচ্ছেন গানে।
‘‘প্রথম কয়েক দিন অস্থির অস্থির লাগছিল। ভাবছিলাম, কী করে এতগুলো দিন একটানা ঘরে থাকব! কখনও এ ভাবে ঘরে থাকিনি তো। কিন্তু যত অসুবিধাই হোক, লকডাউনটা মানাও তো দরকার। তাই ঘরে বসেই কাজ সারছি। আর যখন সময় পাচ্ছি, বাড়িতে সবাই মিলে বসে একটু গল্প করছি। কখনও আবার একটু গানও শুনছি।’’ কোন ধরনের গান পছন্দ সোমেন মিত্রের? প্রবীণ রাজনীতিক বললেন, ‘‘রবীন্দ্রসংগীত। আমি রবীন্দ্রসংগীতই শুনি।’’
ব্যস্ত দেশ হঠাৎ ঘরে ঢুকে গিয়েছে এক ভয়ঙ্কর সংক্রমণ থেকে বাঁচতে। ততোধিক ব্যস্ত থাকেন যাঁরা সারা বছর, তাঁরাও বাধ্যতামূলক ভাবে ঘরবন্দি। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। বিরল পরিস্থিতিতে পড়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্যও বিরল পথ খুঁজে নিতে শুরু করেছেন মন্ত্রী-রাজনীতিকরা। আর তার ফাঁকে তাঁদের অনেকের জীবনেই ফিরেছে সেই সব টুকরো টুকরো মুহূর্ত, যা বিরল হয়ে গিয়েছিল নিরন্তর ছুটে চলার জেরে। প্রতিকূল সময়ের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু ভেঙে পড়ে যে এ লড়াই লড়া যাবে না, জীবনের আনন্দ ধরে রেখেই যে লড়তে হবে, প্রায় প্রত্যেকেই সেই বার্তা দিচ্ছেন এখন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy