প্রতীকী চিত্র।
বেচা-কেনা বন্ধ থাকলে যে ব্যবসা লাটে ওঠে তা জানতে অর্থনীতি পড়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু দেশ ও বিশ্ব জুড়ে করোনার চাপ কতটা তা আন্দাজ করতে কিন্তু অর্থনীতিবিদের প্রয়োজন হয়। আর তাঁদের সম্মিলিত মন্তব্য, বিশ্বায়নের এই দুনিয়ায় করোনার ছোবল শুধু প্রাণঘাতীই নয়, কর্মনাশীও বটে।
কেউ কেউ বলছেন, ভারতের বাজারে ১৩ কোটির উপর চাকরি নাকি খরচের খাতায়! আবার যদি ইউনাইটেড নেশনস বা রাষ্ট্রপুঞ্জের দাবি সত্যি হয়, তা হলে ভারতে আর চিনের বাজারে করোনার ছোবল ততটা প্রাণঘাতী নাও হতে পারে! সত্যি?
মন্দার শুরু হয় বাজারে কোনও কারণে চাহিদা কমতে থাকলে। করোনা ভাইরাসের ত্রাসে জানুয়ারির পর থেকেই এক এক করে দেশ আক্রান্ত হতে শুরু করে। শুরু হয় বন্ধ হওয়ার পালা। মার্চ মাসে এসে তা সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। লকডাউন। নিয়ন্ত্রিত যান-চলাচল। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বাজারে বেচা-কেনা বন্ধ। চাহিদা এক ধাক্কায় শূন্যে। একই ধাক্কায় যোগানও।
আরও পড়ুন: চিন থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ভারতকে গন্তব্য বানাতে আগ্রহী ২০০ মার্কিন সংস্থা
বন্ধ উৎপাদন, কারণ—
ক) বিক্রির উপায় নেই
খ) বিক্রির উপায় থাকলেও শ্রমিকের আসার উপায় নেই।
নীতি নির্ধারকের কাছে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ চাহিদা-জোগানের এই সাঁড়াশি আক্রমণকে প্রতিহত করতে সরকারেরও চাই আর্থিক সামর্থ। কিন্তু আমাদের সরকারের এই মুহূর্তে তা কতটা আছে এবং আগামীতে কতটা থাকবে সেই অঙ্কটা এখনও ধোঁয়াশাই হয়ে আছে। তার কারণ আমরা এখনও জানি না— করোনার ছোবল কতটা বিস্তৃত ও গভীর হয়ে উঠবে।
আর এই কারণেই প্রতিটি চর্চিত হিসাবই কিন্তু এই আঘাতের পরিসর অনুমান করেই তাদের মতামত দিচ্ছে। যেমন ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড বা আইএমএফ। গত ২৭ মার্চ, শুক্রবার, ফান্ডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ক্রিসটালিনা জিওরজিয়েভা, আর্থিক বিষয়ক কমিটির মিটিং শেষে বলেন, “বিশ্বে মন্দা শুরু হয়ে গিয়েছে।” ১৮৯টি দেশ এই কমিটির সদস্য। তাঁর আশ্বাস— ২০২১ সাল থেকেই অবশ্য বিশ্ব বাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। যদি ভাইরাসকে আটকানো যায় আর বাজারে যদি দেউলিয়া হওয়ার কারণে নগদ জোগানের সমস্যা তৈরি না হয়। যদি! অর্থাৎ অনুমানটা হল যে ভাইরাসকে আমরা দ্রুত কব্জা করে ফেলব।
আরও পড়ুন: মধ্যরাতে আসরে ডোভাল, পুলিশ-গোয়েন্দা যৌথ অভিযানে খালি করা হল নিজামউদ্দিন
শুনতে কঠিন লাগলেও ব্যাপারটা সহজ। করোনার কারণে বাজার যদি খুব বেশি দিন বন্ধ থাকে আর একের পর এক সংস্থা লাটে ওঠে, তা হলে কী হবে তা ঈশ্বরই জানবেন! কারণ, এই অঙ্ক করার জন্য একটা আন্দাজ লাগে। আর বিশ্বায়নের দুনিয়ায় এই জাতীয় আঘাতের অভিজ্ঞতা আমাদের প্রথম।
আর হয়ত এই কারণেই, রাষ্ট্রপুঞ্জের অঙ্ক অনেকটাই আলাদা। ফান্ডের রিপোর্টে দেশ ধরে না বলা হলেও, বলা হয়েছে যে— আর্থিক ভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর প্রভূত সাহায্যের প্রয়োজন হবে। আর সেই কথা মাথায় রেখে আপত্কালীন সাহায্য তহবিলের পরিমাণ দ্বিগুণ করছে ফান্ড। পাশাপাশি, রাষ্ট্রপুঞ্জের শাখা সংগঠন, ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট বা অ্যাঙ্কটাড তাদের ৩০ মার্চের রিপোর্টে বলছে করোনার বিষ ঝাড়াতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ২.৫ লক্ষ কোটি ডলারের সাহায্যের প্রয়োজন হবে। তাদের দাওয়াই হল:
• এক লক্ষ কোটি ডলারের অতিরিক্ত স্পেশাল ড্রয়িং রাইটসের ব্যবস্থা করতে হবে আইএমএফ-কে। এটা কিছুটা ওভার ড্রাফটের মতো। সদস্য দেশগুলো বিপদের সময় এই টাকা ধার করতে পারে।
•৫০ হাজার কোটি ডলারের তহবিল মার্শাল প্ল্যানের মতো বিশ্বস্বাস্থ্যব্যবস্থাকে মজবুত করার জন্য তৈরি করতে হবে। প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপকে ঘুরে দাঁড় করাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই তহবিল তৈরি করেছিল।
•উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিশ্ববাজারে যা ধার আছে তার এক লক্ষ কোটি ডলারের মতো ঋণ মকুব করতে হবে।
•আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ শোধের দায় অন্তত দু’বছরের জন্য মকুব করতে হবে।
মজার ব্যাপার হল বিশ্বব্যাঙ্ক তার আলোচনার পরিধি কিন্তু পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিকেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। কিন্তু আমার রাষ্ট্রপুঞ্জে ফিরি। এই আলোচনা করতে গিয়ে এই সমীক্ষা বলছে, চিন এই আঘাত সামলে নেবে আর “ভারতও সম্ভবত পারবে এই আঘাত সামলে নিতে।” সম্ভবত। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে যদিও বলছে রাষ্ট্রপুঞ্জ মনে করছে ভারত আর চিন এই আঘাত সামলে নেবে, মূল রিপোর্ট কিন্তু তা বলছে না। যা বলছে তা হল— এই আঘাত ভারত সামলে উঠলেও উঠতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হল পারবে কিনা তা নিয়ে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা অঙ্ক বলছে— ১৩ কোটির উপর চাকরি যাবে দেশের বাজারে। আর তার বেশির ভাগটাই যাবে সেই সব মানুষের যাঁরা সংগঠিত ক্ষেত্রের নয়। এই অঙ্কটা আমরা একটু অভিজ্ঞতার নিরিখে খতিয়ে দেখি। ২০১১-১২ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী ভারতে কর্মীর সংখ্যা ৪৭.৪১ কোটি। তার মধ্যে ৩৩.৬৯ শতাংশ কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কাজ করেন। এঁদের মধ্যে আবার ৩৫.৩ শতাংশ দিন-আনি-দিন-খাই গোত্রের।
কিন্তু সব মিলিয়ে সরকারি খাতার বাইরে কত জন আছেন তাঁর কোনও পরিষ্কার অঙ্ক আমাদের কাছে নেই। আর বাজার বন্ধ হওয়ায় এঁদের পেটেই প্রথম টান পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। ২০১৮ সালের আর্থিক সমীক্ষায় প্রথম এঁদের কথা স্থান পায়। সমীক্ষার দাবি, দেশের মোট কর্মীর ৯৩ শতাংশই কাজ করেন বিভিন্ন অসংগঠিত সংস্থায় এবং এঁদের কোনও সামাজিক সুরক্ষা নেই। এঁরা যে সংস্থায় কাজ করেন তারা কর দেয় না এবং তাদের অস্তিত্বও সরকারি খাতায় নেই। আর এই সব সংস্থাই নাকি দেশের মোট উৎপাদনের ২১ শতাংশের জন্য দায়ী!
নীতি আয়োগ অবশ্য একই বছর তাদের সমীক্ষায় বলে এই জাতীয় শ্রমিকের সংখ্যা ৮৫ শতাংশ। আর্থিক সমীক্ষার থেকে ৮ শতাংশ বিন্দু কম!
এ বার আসি অনুমানের অঙ্কে। করোনার ছোবলে কত চাকরি মারা পড়তে পারে সেই প্রশ্নে। আপনি যে পাড়ার দোকান থেকে চাল ডাল কেনেন তার জোগানের ছেলেটি, আপনার বাড়িতে আয়া, পানের দোকানের সাহায্যকারী, কারখানার মজদুর এঁরা সবাই কিন্তু সামাজিক সুরক্ষার বাইরে এবং এঁদের একটা বড় অংশই কিন্তু দিনের কাজের ভিত্তিতে পয়সা পান। সমীক্ষার অঙ্ক আর আদমসুমারি মিলিয়ে যদি দেখি, তা হলে দেখছি মোট কর্মীর সংখ্যা ৪৭.৪১ কোটি মেনে, তার ৮০ শতাংশই যদি ধরি, তা হলে প্রায় ৩৮ কোটি কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কাজ হারানোর দলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরাই দলে ভারি হবেন। এঁদের মধ্যে কতজন মাস মাইনে পান আর কতজন দিন-আনি-দিন-খাই ক্ষেত্রে বিচরণ করেন তা হিসাব করা খুব কষ্টসাধ্য। আপনার বাড়ির কাজের মাসির মাইনে আপনি দেবেন। না এলেও। কিন্তু মাল বহন করে যিনি খান, তিনি? নির্মাণ শিল্পের কর্মীরা? আর এইখানে এসেই অঙ্কটা গোলাতে থাকে কারণ কতজন এঁদের মধ্যে হপ্তা পান, কত জন মাস মাইনের বা দিনের মজুরির তা আমরা জানি না। অভিঘাত বেশি হবে দিন-আনি-দিন-খাই গোত্রের উপরই।
আরও পড়ুন: আইসিএসই-র বাকি পরীক্ষা ১৬ এপ্রিল থেকে? সম্পূর্ণ ভুয়ো খবর
ব্যবসা বন্ধ তো আয় বন্ধ। কিন্তু কত দিন ব্যবসা বন্ধ থাকবে তার উপর নির্ভর করবে কাজ থাকবে না কি থাকবে না তার অঙ্ক। এক মাস বাজার বন্ধ থাকলে তার অভিঘাত কম হবে। তার বেশি হলে বেশি। তাই প্রচুর লোকের কাজ যাবে এটা বুঝতে খুব একটা অঙ্ক করার দরকার নেই। কিন্তু কত জনের তা বুঝতে কিন্তু করোনার স্থায়িত্বের অঙ্কটা জানা জরুরি। তবে দু’মাস বন্ধ থাকলে কাজ হারানোর অঙ্কটা ১৩ কোটিতে বোধহয় আটকে থাকবে না।
আমরা ঠাট্টা করে বলি ‘চপের অর্থনীতি’। আর এই চপের অর্থনীতিই ভারতকে টানে। ভারতের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কর্মীর আয় আসে এই অর্থনীতি থেকেই। সব্জির ডালা, টায়ার সারাইয়ের থেকে রাস্তার ধারে চায়ের দোকান যে সংসার এত দিন টেনেছে, বাজার খুললে সেই ক্ষেত্রই কিন্তু সহায় হয়ে উঠবে। তবে বাজারে করোনার ছোবল যদি দু’মাস ছোঁয়, তা হলে কী হবে তার অঙ্ক কষে বার করা খুবই কঠিন। কিন্তু অভিঘাত যে ভয়াবহ তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। অন্তুত আগামী এক বছরের হিসাবে। হয়ত আশাবাদীরা ভারতের নাগরিকের শতাব্দী প্রাচীন টিকে থাকার ইতিহাসকেই আলো হিসাবে ধরে রাখছেন। আমরা শুধু অপেক্ষা করতে পারি সময়ের উত্তরের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy