মহামারি: ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু-এ মৃত্যুমিছিল শুরু হয়েছিল ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে।
১৯১৮ সালের মার্চ মাসের এক সকালে কিছুটা শরীর খারাপ নিয়েই ঘুম থেকে উঠেছিলেন আমেরিকার সেনাবাহিনীর রাঁধুনি অ্যালবার্ট গিচেল। গলা-শরীরে ব্যথা, সেই সঙ্গে জ্বর। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কানসাসের ওই সেনা-শিবিরের আরও অনেক সেনাই একই উপসর্গে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এতটাই দ্রুত সেই সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। যেমন দ্রুততার সঙ্গে বর্তমানে ফের ছড়াচ্ছে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ। আর এই সংক্রমণ ছড়ানোর নেপথ্যে সাধারণ মানুষের কোভিড-বিধি মেনে চলার অনীহা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে প্রশাসনের উদাসীনতা। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
তাঁরা এ-ও জানাচ্ছেন, বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’-র ঘটনাক্রমের মিল রয়েছে। স্প্যানিশ ফ্লু-র ইতিহাস বলছে, গিচেলের অসুস্থ হওয়ার পরে মাত্র এক মাসের মধ্যে ৩৮ জন ওই সংক্রমণে মারা গিয়েছিলেন। আরও বিপুল সংখ্যক সেনাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। ইতিহাসের একটি সূত্র বলছে, ১৯১৮ সালের ‘স্প্যানিশ ফ্লু’-এর ‘পেশেন্ট জিরো’ ছিলেন গিচেল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেনাবাহিনীর এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাতায়াতের মাধ্যমে এই সংক্রমণ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন ও ইটালিতে।
গবেষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, স্প্যানিশ ফ্লু-র প্রথম ঢেউ (ফার্স্ট ওয়েভ) ততটা বিপজ্জনক ছিল না। জ্বর ও শরীর-গলায় ব্যথার মতো উপসর্গ ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত এক গবেষকের কথায়, ‘‘সেই সময়ের যে সীমিত তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে, স্প্যানিশ ফ্লু-র প্রথম ঢেউয়ের সংক্রমণে মৃতের হার ছিল মরসুমি ফ্লু-র মতোই।’’
এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছিল, তা হলে সংক্রমণ থেমেছে। তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই নিজেদের অভ্যস্ত জীবনে ফিরতে শুরু করেছিলেন। ১৯১৮ সালের অগস্ট মাস নাগাদ এই ধারণাই আরও দৃঢ় হয়েছিল যে, সংক্রমণ-বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। ফলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়। কিন্তু এক সংক্রামক রোগ গবেষক জানাচ্ছেন, এক দিকে সাধারণ মানুষ যখন ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের দিকে ঝুঁকছিলেন, সেই সময়েই স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাসের একটি নতুন স্ট্রেনের খোঁজ মিলেছিল। যার সংক্রামক ও মারণ ক্ষমতা— দু’টিই ছিল মারাত্মক। এবং নিজেদের অজানতেই এই নতুন স্ট্রেনে সংক্রমিত সেনারা যখন আমেরিকা, ফ্রান্স-সহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন, তখন আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বব্যাপী মহামারির সূত্রপাত হয়।
যার ফলে ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে মৃত্যুর হার হঠাৎ করেই আকাশচুম্বী হয়ে যায়। সেখানেই শেষ নয়। ১৯১৯ সালের শীত ও বসন্তে তৃতীয় ঢেউ আসে সংক্রমণের। আরও বাড়ে মৃতের সংখ্যা। শেষ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। তবে অনেকে মনে করেন, এই মৃত্যুমিছিলের জন্য স্বাস্থ্যকর্তাদের সিদ্ধান্তহীনতা দায়ী। যেমন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যুক্ত প্রাক্তন এক সংক্রামক রোগ চিকিৎসকের কথায়, ‘‘অনেক সরকারি আধিকারিক ভাল ভাবেই জানতেন, পুরোপুরি লকডাউনের মাধ্যমে এই সংক্রমণের গতি ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু যুদ্ধের উপরে প্রভাব ফেলবে বলে তা জানার পরেও সেটা তাঁরা করেননি।’’
বর্তমানে নির্বাচনের প্রচারে যাতে কোনও প্রভাব না পড়ে, সে কারণে যেমন কোভিড-বিধি উপেক্ষা করেই সব রাজনৈতিক দল প্রচার চালাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। এমনিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ কোভিড-বিধির ন্যূনতম পরোয়া করছেন না। তার উপরে রাজনৈতিক দলগুলি এমন ভাবে মিছিল-সমাবেশের আয়োজন করছে, যাতে সংক্রমণের হার ত্বরান্বিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আঞ্চলিক কার্যালয়’-এর ‘কমিউনিকেবল ডিজ়িজ়’-এর প্রাক্তন ডিরেক্টর রাজেশ ভাটিয়ার কথায়, ‘‘করোনা সংক্রমণ কোন দিকে এগোচ্ছে, এক বছর পরেও সেই সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হল, সাধারণ মানুষ মাস্ক পরা বা নিয়ম পালনের ক্ষেত্রে খুব গা-ছাড়া ভাব দেখাচ্ছেন। এমন অসঙ্গত আচরণের (ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট বিহেভিয়র) কারণে আমাদের বড় মূল্য দিতে হবে।’’ অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স-এর বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান তথা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এল এম শ্রীবাস্তবের সতর্কবার্তা, পশ্চিমবঙ্গ-সহ যে সব রাজ্যে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে নিয়ম পালনের ক্ষেত্রে কেউই কোনও তোয়াক্কা করছেন না। কিন্তু এটা মনে রাখা প্রয়োজন, স্প্যানিশ ফ্লু-র দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউয়ের সময়েও এমনটাই হয়েছিল। তাঁর কথায়, ‘‘জনগোষ্ঠীর একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অপরিণামদর্শিতা ও প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে আমরা কি ক্রমশ আর একটা স্প্যানিশ ফ্লু-র দিকে এগোচ্ছি? এখন এই প্রশ্নটা সব চেয়ে আগে করা উচিত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy