প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে পাঠানো সেই চিঠি। নিজস্ব চিত্র।
করোনা-কালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন চিঠি লিখে কেন্দ্রের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, সেই সময়েই কিছু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের অন্ধকারে রেখে জেলাশাসকদের সরাসরি বৈঠকে ডাকলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ওই বৈঠকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এমনকি, কোন অফিসারদের ডাকা হচ্ছে, সেই বিষয়েও মুখ্যমন্ত্রীরা অবহিত ছিলেন না! অতীতে ‘পিএম টু ডিএম, মাইনাস সিএম’ কৌশল ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল। এ বারেও মোদীর এমন পদক্ষেপ ঘিরে তুমুল প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বিতর্ক বেধে গিয়েছে।
অনেকেরই বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী এ ভাবে জেলাশাসক স্তরের অফিসারদের ডেকে বৈঠক করলে নানা রকম প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হতে পারে। কারণ, অফিসারেরা প্রধানমন্ত্রী না মুখ্যমন্ত্রী— কার নির্দেশ মানবেন, কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে সেই টানাপড়েন। তাতে কাজের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বৈঠক ডেকেছেন ২০ মে বেলা ১১টায়। তাতে বিভিন্ন রাজ্যের যে-সব অফিসারকে ডাকা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে বাংলার ন’জন জেলাশাসক আছেন। বৈঠকে মুখ্যসচিব-সহ কিছু অফিসারকেও (যাঁরা কোভিড ব্যবস্থাপনায় যুক্ত) থাকতে বলা হয়েছে। এ দিন প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১০টি রাজ্যের (অন্য ন’টি রাজ্য হল মহারাষ্ট্র, কেরল, হরিয়ানা, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, ওড়িশা, পুদুচেরি) মুখ্যসচিবদের কাছে। এ রাজ্যের মুখ্যসচিব ছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম, নদিয়া, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর ও হুগলির জেলাশাসকদের বৈঠকে থাকতে বলা হয়েছে।
নবান্ন সূত্রের খবর, ক্ষুব্ধ মমতা মনে করছেন, মুখ্যমন্ত্রীদের ‘এড়িয়ে’ সরাসরি ‘পিএম টু ডিএম’ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জেলাশাসকদের এই ধরনের সরাসরি বৈঠক রীতিবিরুদ্ধ। অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত ভাবে প্রতিবাদ জানানোর কথা ভাবছেন তিনি। সেই প্রতিবাদপত্র অন্য মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে পাঠিয়ে এই ব্যাপারে তাঁদের অবহিত করাতে চাইছেন, যাতে পরবর্তী স্তরে বিষয়টি নিয়ে ‘ঐক্যবদ্ধ’ পদক্ষেপ করা যায়।
প্রবীণ আমলারা জানাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজীব গাঁধীও এক বার পঞ্চায়েত নিয়ে এই ধরনের বৈঠক ডেকে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে কেন্দ্র একাধিক বার সরাসরি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিতর্কে জড়িয়েছে। তখনও সেই আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু এ বারের পরিস্থিতির গুরুত্ব অন্য রকম।
প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলার অধিকাংশ দায়িত্ব এখন রাজ্যের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে কেন্দ্র। সব জেলা প্রশাসনকে এক সূত্রে বেঁধে কোভিড মোকাবিলার রূপরেখা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। অক্সিজেন, প্রতিষেধক, কোভিড চিকিৎসার যাবতীয় বিষয়ে তাঁর নির্দেশেই কাজ হচ্ছে সর্বত্র। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীকে এড়িয়ে গেলে কার্যক্ষেত্রে তার কোনও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে না।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এই ধরনের বৈঠক প্রধানমন্ত্রী সরাসরি ডাকতে পারেন না, এমন কথা হয়তো বলা যায় না। বিশেষত, বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী অতিমারি পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের হাতে প্রভূত ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। প্রধানমন্ত্রী যদি কোনও নির্দেশ দেন, তা মুখ্যমন্ত্রীর অধীনে থাকা আমলাদের কাছে উভয়সঙ্কট তৈরি করতে পারে। তৈরি হতে পারে প্রশাসনিক জটিলতাও। তাই এমন পদক্ষেপ প্রথাসিদ্ধ নয়। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয়
কেন্দ্র ও রাজ্যের এক্তিয়ারের বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার। প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীরা যে বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য অফিসারদের ছাড়তে অপারগ হতে পারেন, সেটাও বিবেচনায় রাখা জরুরি।
প্রাক্তন আমলারা জানাচ্ছেন, জাতীয় স্তরে বিপর্যয় মোকাবিলা কমিটি থাকে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। রাজ্য স্তরের কমিটি থাকে মুখ্যমন্ত্রীর অধীনে এবং জেলা স্তরে জেলাশাসকের অধীনে। জাতীয় কমিটি জেলা কমিটিকে কোনও নির্দেশ দিতেই পারে। তবে রাজ্য কমিটির মাধ্যমে সেই নির্দেশ দেওয়াই রীতিসম্মত। প্রাক্তন আইএএস অফিসার কান্নান গোপীনাথন বলেন, “বরাবরই রাজ্যের নির্বাচিত সরকারকে এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী সেখানকার প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চান। এতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। এই লড়াই নিজেদের মধ্যে নয়। জটিলতা এড়াতে প্রধানমন্ত্রী যদি মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে নির্দেশ দেন, তা হলে সুষ্ঠু ভাবে কাজ করা সম্ভব।”
প্রধানমন্ত্রীর ডাকা ওই বৈঠক ঘিরে পারদ চড়েছে রাজনৈতিক মহলেও। তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় বলেন, ‘‘এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী। কোন কোন জেলার কাছ থেকে তথ্য নিতে হবে, সেটা কে ঠিক করল? রাজ্যের পরিস্থিতি যদি বুঝতে হয়, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই কথা বলা উচিত। তাঁর কাছেই সব তথ্য রয়েছে। এখন হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য প্রশাসনকে এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী যে-ভাবে জেলাশাসকদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন, তা মেনে নেওয়া যায় না।’’ আইনজীবী এবং সিপিএম সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বিপর্যয় মোকাবিলা আইন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীই গোটা ব্যবস্থার শীর্ষে এবং তাঁর হাতে অনেক ক্ষমতা। এখন সেই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তিনি যদি এই ধরনের বৈঠক করেন, সে-ক্ষেত্রে গোটা কোভিড মোকাবিলার দায়িত্বই তাঁকে নিতে হবে। রাজ্যের ঘাড়ে চাপানো যাবে না। সকলের জন্য ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা-সহ এই সঙ্কটের পরিস্থিতিতে সব দায়িত্ব নিতে হবে কেন্দ্রকে। এই দাবিতে আমরা আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছি ইতিমধ্যে।’’
যদিও রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘বিপর্যয়ের সময়ে প্রধানমন্ত্রী একেবারে নিচু তলা থেকে মোকাবিলা করতে চাইছেন। তৃণমূল স্তরের অবস্থা বুঝতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা বলে এই বিশেষ পরিস্থিতিতে এমন উদ্যোগের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy