Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
No Confidence Motion

সেই বাদল অধিবেশনেই আবার মোদীর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনল বিরোধীরা, তবে বুধেও অচল সংসদ

স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই নিয়ে ২৮তম অনাস্থা প্রস্তাব এল লোকসভায়। অতীতে দেশের তিন প্রধানমন্ত্রী, মোরারজি দেশাই, ভিপি সিংহ এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী অনাস্থা প্রস্তাবেই গদি হারিয়েছিলেন।

Graphical representation

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৩ ২২:৩৯
Share: Save:

লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা এখনও দিনক্ষণ ঘোষণা করেননি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনে কংগ্রেস এবং ভারত রাষ্ট্র সমিতির তরফে জমা দেওয়া দু’টি নোটিস গ্রহণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, চলতি বাদল অধিবেশনেই সংসদের নিম্নকক্ষে শক্তিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে। গত ন’বছরে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এই নিয়ে দ্বিতীয় বার। বুধবার বিরোধী দলগুলির জোট ‘ইন্ডিয়া’র হয়ে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ। বিআরএসের হয়ে অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিস জমা দেন সাংসদ নামা নাগেশ্বর রাও। উল্লেখ্য যে, তেলঙ্গানার শাসকদল বিআরএস ২৬টি বিরোধী দলের জোট ‘ইন্ডিয়া’য় অংশ নেয়নি। তবে সাম্প্রতিক অতীতে বহু বার বিজেপির বিরোধিতায় সরব হতে দেখা গিয়েছে তাদের।

সংসদীয় বিধি অনুযায়ী লোকসভার স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিস গ্রহণ করার ১০ দিনের মধ্যেই তা নিয়ে সংসদে বিতর্কের সূচনা হওয়ার কথা। এ বিষয়ে দিন নির্ধারণের ক্ষমতা এক মাত্র স্পিকারের। ইতিহাস বলছে, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই নিয়ে ২৮তম অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে চলেছে। অতীতে দেশের তিন প্রধানমন্ত্রী, মোরারজি দেশাই, ভিপি সিংহ এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী বিরোধীদের আনা এমন অনাস্থা প্রস্তাবেই গদি হারিয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম অনাস্থা প্রস্তাবটি এনেছিলেন জেবি কৃপালণী।

বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব আনলেও মোদী সরকারের পতনের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। কারণ ৫৪৩ সাংসদের লোকসভায় সরকারের পতন ঘটনার জন্য প্রয়োজন ২৭২ সাংসদের সমর্থন। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সাংসদ সংখ্যা ৩৩২। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের পর মোদীই দু’টি অনাস্থা জয়ের নজির তৈরি করবেন। বিরোধী দলগুলির অবশ্য বক্তব্য, মণিপুর নিয়ে সরকারের ‘নীরবতা’ ভাঙাতেই তারা সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে। এই প্রসঙ্গে ‘ইন্ডিয়া’র অন্যতম শরিক শিবসেনার তরফে বলা হয়েছে, মণিপুর নিয়ে বক্তব্য রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদী যাতে সংসদে আসেন, সেই কারণেই অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছে। বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব সম্পর্কে সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং বিজেপির উপর মানুষের আস্থা রয়েছে। বিরোধীরা আগেও অনাস্থা প্রস্তাব এনেছেন। কিন্তু মানুষ ওদের উচিত শিক্ষা দিয়েছে।”

গত তিন মাস ধরে গোষ্ঠী সংঘর্ষে উত্তপ্ত মণিপুর। সম্প্রতি মণিপুরে দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে ঘোরানো এবং গণধর্ষণের অভিযোগের কথা প্রকাশ্যে এসেছে। একটি ভিডিয়োও প্রকাশ্যে এসেছে সমাজমাধ্যমে (যে ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন)। এই ঘটনাকে ঘিরে নতুন করে উত্তাপ তৈরি হয়েছে জাতীয় রাজনীতিতে। ৭৮ দিন চুপ থাকার পর গত ২০ জুলাই বাদল অধিবেশন শুরুর আগে সংসদ ভবন চত্বরে মণিপুর নিয়ে মুখ খোলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তিনি বলেছিলেন, ‘‘মণিপুরের ঘটনা যে কোনও সভ্য সমাজের পক্ষে লজ্জার।’’ পাশাপাশি, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বাংলা, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ের মতো বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। অধিবেশন শুরুর আগে মোদীর ওই মন্তব্যে ক্ষোভের প্রশমন যে ঘটেনি, তা বিরোধীদের বিক্ষোভেই স্পষ্ট। মণিপুরের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে সরব বিরোধীদের ধারাবাহিক বিক্ষোভে টানা পাঁচ দিন ধরে কার্যত অচল সংসদের বাদল অধিবেশন।

পাঁচ বছর আগেই ‘ভবিষ্য়দ্বাণী’ মোদীর

বিরোধীদের আনা অনাস্থার আবহেই আবহেই সংসদে প্রধানমন্ত্রী মোদীর একটি পুরনো বক্তৃতা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী জানাচ্ছেন যে, ২০২৩ সালে আবারও অনাস্থা প্রস্তাব আনার ‘সুযোগ পাবেন’ বিরোধীরা। ভিডিয়োটি টুইট করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ। তবে এই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।

বিজেপির দাবি, ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে সংসদের বাজেট অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক চলছিল। সেই সময় জবাবি বক্তব্য রাখতে উঠে বিরোধী বেঞ্চের উদ্দেশে মোদী বলেছিলেন, “আমি (আপনাদের) শুভেচ্ছা জানাতে চাই। প্রস্তুত থাকুন, কারণ আপনারা আবার ২০২৩ সালে অনাস্থা প্রস্তাব আনার সুযোগ পাবেন।” সেই দিনের বক্তব্যে কংগ্রেসের নাম না করেই মোদী বলেছিলেন, “অহঙ্কারের কারণে আপনারা ৪০০ (লোকসভার সাংসদ) থেকে ৪০-এ এসে পৌঁছেছেন।”

এই ভিডিয়োটি তুলে ধরেই বিজেপির তরফে মোদীর ‘নির্ভুল অনুমান’-এর প্রশংসা করা হচ্ছে। তবে রাজনীতির কারবারিদের একাংশ মনে করছেন, চার বছর আগে সংসদে ওই বক্তব্য রেখে মোদী বিরোধীদের উদ্দেশে এই বার্তাই দিতে চেয়েছিলেন যে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে সংসদের বাদল অধিবেশনেই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)। সেই প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছিল কংগ্রেস-সহ কয়েকটি বিজেপি-বিরোধী দল। বিজেপির সংখ্যাধিক্যের জোরে বিরোধীদের আনা প্রস্তাব খারিজ হয়ে গিয়েছিল।

শাহকে জবাব খড়্গের

অনাস্থা প্রস্তাব ঘিরে সরকার এবং বিরোধী পক্ষের ‘তৎপরতার’ আবহেই বুধবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মঙ্গলবারের চিঠির জবাব দিলেন রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে। শাহকে পাঠানো উত্তরে খড়্গে লিখেছেন, ‘‘চিঠিতে আবেগ প্রকাশ করা সহজ। কিন্তু ক্ষমতাসীন এনডিএ-র উচিত, বিরোধীদের আস্থা অর্জনের মতো সহজতর বিষয়টিতে আরও গুরুত্ব দেওয়া।’’ সেই সঙ্গে কংগ্রেস সভাপতি খড়্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে লিখেছেন, ‘‘আপনার আচরণের মাধ্যমে সহজেই বিরোধী নেতৃত্বের আস্থা অর্জন করতে পারেন।’’

মণিপুরকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিবৃতির দাবিতে সংসদে ধারাবাহিক বিক্ষোভ চালাচ্ছেন বিরোধী সাংসদেরা। এই আবহে মঙ্গলবার রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা খড়্গে এবং লোকসভার বৃহত্তম বিরোধী দল কংগ্রেসের দলনেতা অধীর চৌধুরীকে চিঠি পাঠিয়ে সংসদ চালাতে সহায়তার আবেদন জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ। টুইটারে সে কথা জানিয়ে শাহ লেখেন, ‘‘আমি আজ সংসদের উভয় কক্ষের বিরোধী নেতা শ্রী অধীরজি এবং শ্রী খড়্গেজিকে মণিপুরের ঘটনা নিয়ে আলোচনার জন্য সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছি। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সরকার মণিপুর নিয়ে আলোচনায় সব পক্ষের সাহায্য চায়। আমার আশা, এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানের জন্য সব পক্ষ আমাদের সহযোগিতা করবে।’’

শাহের এমন আবেদনের পরেও অবশ্য রাজ্যসভায় বুধবার খড়্গের বক্তৃতায় বাধা দেন বিজেপি সাংসদেরা। তাঁরা ক্রমাগত ‘মোদী, মোদী’ স্লোগান তোলেন। এক সময় ট্রেজারি বেঞ্চের উদ্দেশে বিরোধী দলনেতা খড়্গে বলেন, ‘‘এটি স্বাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। এটি আমার অপমান। আমার আত্মসম্মানকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। যদি এই সভা সরকারের নির্দেশে পরিচালিত হয়, তা হলে আমি বুঝব এখানে গণতন্ত্র নেই।’’

লোকসভায় পাশ বিতর্কিত বন সরক্ষণ বিল

মণিপুরে ধারাবাহিক হিংসা এবং নারী নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে সংসদে বিরোধীদের বিক্ষোভের মধ্যেই বুধবার বাদল অধিবেশনের পঞ্চম দিনে বিতর্কিত বন সংরক্ষণ (সংশোধনী) বিল লোকসভায় পাশ করিয়ে নিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। বিরোধীদের অভিযোগ, কারখানা তৈরি, খনিজ পদার্থ উত্তোলন-সহ নানা বিনিয়োগের জন্য শিল্পপতিদের হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার অরণ্যভূমি তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই নজিরবিহীন দ্রুততায় নয়া বন সংরক্ষণ আইন কার্যকর করতে সক্রিয় হয়েছে কেন্দ্র।

কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব বুধবার লোকসভায় বন সংরক্ষণ সংশোধনী বিল পেশ করেন। কোনও আলোচনা ছাড়াই তা পাশ হয়ে যায়। গত এপ্রিলে বাজেট অধিবেশনে সরকারপক্ষের তরফে বিলটি পেশের পরে তা পাঠানো হয়েছিল সংসদের সিলেক্ট কমিটিতে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে বিল পাঠানো হয়নি। স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান, ইউপিএ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশ সে সময় বলেছিলেন, ‘‘আমি স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান বলেই ওই কমিটিতে বিল পাঠানো হয়নি।’’

বিজেপির ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের সুবিধা পাইয়ে দিতে ওই বিলের খসড়া চূড়ান্ত করা হবে বলে সে সময়ই অভিযোগ করেছিলেন রমেশ। নয়া বিলে যে ভাবে সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত বনভূমি ধ্বংসের সংস্থান রাখা হয়েছে, তাতে জনজাতিদের স্বার্থে ইউপিএ আমলে চালু করা ‘অরণ্যের অধিকার আইন’ লঙ্ঘিত হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক এবং ইকো-ট্যুরিজমের অছিলায় শিল্পগোষ্ঠীগুলি সহজেই সরকারি ব্যবস্থাপনা কাজে লাগিয়ে অরণ্যবাসী জনজাতিদের উৎখাত করতে পারবে বলে অভিযোগ। যদিও ভূপেন্দ্র বলেন, ‘‘রেললাইন, সড়কের মতো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যই অরণ্যভূমির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে বিলের খসড়ায়।’’

অন্য বিষয়গুলি:

no confidence motion Monsoon Session of Parliament Narendra Modi Lok Sabha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy