মঙ্গলবার অম্বেডকর নিয়ে রাজ্যসভায় অমিত শাহের মন্তব্যের পর বৃহস্পতিবারও দিনভর উত্তপ্ত ছিল সংসদ। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতা বিআর অম্বেডকরকে নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক অব্যাহত। বৃহস্পতিবার সেই বিতর্ককে কেন্দ্র করেই সংসদে কংগ্রেস এবং বিজেপি সাংসদেরা ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। দিনের শেষে তার জল গড়াল থানাপুলিশ পর্যন্ত। বিজেপি এবং কংগ্রেস, দুই দলের তরফেই পার্লামেন্ট স্ট্রিট থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে দুই সাংসদকে আঘাত করার অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। আবার কংগ্রেসের পাল্টা অভিযোগ, তাঁদের বর্ষীয়ান সাংসদ মল্লিকার্জুন খড়্গেকে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে, তাতে তিনি পড়ে গিয়েছেন। চক্রান্ত করে বৃহস্পতিবার সংসদ উত্তপ্ত রেখেছে বিজেপি, দাবি করেছেন রাহুল। তাঁর অভিযোগ, মঙ্গলবার শাহের মন্তব্যের কারণে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তার দিক থেকে নজর ঘোরাতেই পরিকল্পনা করে সংসদে অশান্তি করেছে কেন্দ্রের শাসকদল। বিরোধী সাংসদদের দিকে তাকিয়ে তারা হাসাহাসি করছিল বলেও অভিযোগ।
বিতর্কের সূত্রপাত মঙ্গলবার রাজ্যসভায়। অম্বেডকর নিয়ে শাহের মন্তব্যের বিরোধিতা করে কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলি। তাঁর বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিস জারি করে তৃণমূল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওই মন্তব্যের নিন্দা করেন। রাহুল দাবি করেন, শাহকে অবিলম্বে নিজের মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। তা না হলে তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে। বুধবার দিনভর অম্বেডকর বিতর্কে সংসদ উত্তপ্ত থেকেছে। বৃহস্পতিবার সকালেও শাহের মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সংসদে ঢুকছিল কংগ্রেস। কিন্তু কক্ষে প্রবেশের আগেই ঝামেলা বাধে। অভিযোগ, পাল্টা প্রতিবাদ করতে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিজেপি সাংসদেরা। বিরোধীরা এগোলে দু’পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ, হাতাহাতি শুরু হয়। এই সময়েই ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে যান বিজেপি সাংসদ প্রতাপচন্দ্র ষড়ঙ্গী এবং মুকেশ রাজপুত। অভিযোগ, রাহুলের ধাক্কায় মুকেশ পড়েছিলেন ষড়ঙ্গীর গায়ের উপর। দু’জনেই মাথায় চোট পান। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
বিজেপির বিরুদ্ধে পাল্টা ধাক্কাধাক্কির অভিযোগ তোলে কংগ্রেস। খড়্গে জানান, তাঁকে বিজেপি সাংসদেরা ধাক্কা মেরেছেন। লোকসভার স্পিকারের কাছে এ নিয়ে অভিযোগও জানিয়েছেন তিনি। বিতর্কের মাঝে নাগাল্যান্ড থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ ফাঙ্গনন কন্যাক দাবি করেন, রাহুল তাঁর শরীরের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন! ফলে তাঁর অস্বস্তি হচ্ছিল। কংগ্রেস সাংসদের কাছ থেকে এই ধরনের আচরণ তিনি আশা করেননি বলেও জানান। বিকেলে রাহুল সাংবাদিক বৈঠক করে দাবি করেন, অম্বেডকর নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে শাহ যে ভুল করেছেন, তা ধামাচাপা দিতেই নতুন বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সংসদের বাইরে অশান্তি বিজেপির পূর্বপরিকল্পিত বলেও দাবি করেন তিনি।
হাসপাতালে দুই সাংসদ
শাহের অম্বেডকর-মন্তব্য নিয়ে বিরোধীদের বিক্ষোভের সময়ে সংসদের বাইরে ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে যান বিজেপির দুই সাংসদ। বালেশ্বরের সাংসদ ষড়ঙ্গী এবং উত্তরপ্রদেশের ফারুখাবাদের সাংসদ মুকেশ মাথায় চোট পেয়েছেন। তাঁরা রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহত সাংসদ ষড়ঙ্গী বলেন, ‘‘রাহুল গান্ধী এক সাংসদকে ধাক্কা মারেন। তিনি আমার গায়ের উপর পড়েন। ফলে আমি মাটিতে পড়ে যাই।’’
রাহুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের
বৃহস্পতিবার বিজেপির তরফে পার্লামেন্ট স্ট্রিট থানায় রাহুলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন সাংসদ অনুরাগ ঠাকুর। অভিযোগ, রাহুলের ধাক্কাতেই তাঁদের দুই সাংসদ আহত হয়েছেন। আহত সাংসদেরাও সেই অভিযোগ করেছেন। অনুরাগ থানা থেকে বেরিয়ে বলেন, ‘‘আমরা ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১০৯, ১১৫, ১১৭, ১২৫, ১৩১ এবং ৩৫১ ধারায় মামলা রুজু করেছি। ১০৯ খুনের চেষ্টার ধারা। ১১৭-তে রয়েছে ইচ্ছাকৃত ভাবে গুরুতর আঘাত করা।’’ সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, রাহুলের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে দিল্লি পুলিশ। ১১৭, ১২৫, ১৩১ এবং ৩৫১ ধারায় এফআইআর করা হয়েছে।
থানায় কংগ্রেসও
কংগ্রেসের তরফেও থানায় পাল্টা অভিযোগ দায়ের করা হয়। কয়েক জন সাংসদের একটি দল পার্লামেন্ট স্ট্রিট থানায় যান। মহিলা সাংসদেরাও সেই দলে ছিলেন। খড়্গেকে ধাক্কা এবং মহিলা সাংসদদের অপমানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন তাঁরা। কংগ্রেস সাংসদ প্রমোদ তিওয়ারি পরে বলেন, ‘‘যে ভাবে এক জন দলিত নেতাকে আগের দিন সংসদে অপমান করা হয়েছে, যে ভাবে আজ দলিত সাংসদকে ধাক্কা দেওয়া হল— সবই একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অঙ্গ বলে মনে হচ্ছে।’’
তৃণমূলকে ধন্যবাদ
শাহের মন্তব্য নিয়ে বিতর্কের মাঝে তাঁর বিরুদ্ধে সংসদে স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিস জারি করে তৃণমূল। অম্বেডকরের পৌত্র তথা প্রাক্তন সাংসদ প্রকাশ অম্বেডকর এ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘বাবাসাহেবের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের অসম্মানজনক মন্তব্য সহ্য করা হবে না। অম্বেডকর-বিরোধী মানসিকতাকে নির্মূল করতে রাজপথ থেকে সংসদ পর্যন্ত লড়াই করা হবে। এই ধরনের মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আমি খুশি যে তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন এই লড়াইয়ের একজন অংশীদার হয়েছেন।’’
স্পিকারকে চিঠি খড়্গের
রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা খড়্গে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাকে চিঠি দিয়েছেন। জানিয়েছেন, কেন্দ্রের শাসকদল সংসদের মর্যাদাহানি করেছে। আগে থেকেই বিজেপি সাংসদেরা হাতে লাঠি এবং প্ল্যাকার্ড নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন বলে দাবি তাঁর। অভিযোগ, বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র সদস্যেরা শান্তিপূর্ণ ভাবে শাহের মন্তব্যের প্রতিবাদ করছিলেন। কিন্তু তাতে বিজেপি বাধা দেয়। ইচ্ছাকৃত ভাবে তারা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে, চিঠিতে জানিয়েছেন খড়্গে। তাঁর অভিযোগ, বিজেপি সাংসদদের ধাক্কায় তিনি পড়ে গিয়েছেন এবং হাঁটুতে আঘাত পেয়েছেন।
তদন্তের দাবি
লোকসভার স্পিকারকে পৃথক চিঠি দিয়েছেন কংগ্রেস সাংসদেরাও। তাঁরা বৃহস্পতিবারের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। রাহুলকে শারীরিক ভাবে হেনস্থা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তাঁদের। বিরোধী দলনেতার এই হেনস্থার সঠিক তদন্ত দাবি করেছে কংগ্রেস।
সংবিধান পাশে নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে রাহুল
থানায় অভিযোগ দায়েরের পর বিকেলে খড়্গেকে পাশে নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন রাহুল। সামনে রাখা ছিল ভারতের সংবিধান। তিনি বলেন, ‘‘বিজেপির মনোভাব বরাবরই অসাংবিধানিক এবং অম্বেডকর-বিরোধী। শাহ সে দিন রাজ্যসভায় এই মনোভাব প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। সেটাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার ওরা (বিজেপি) নতুন অশান্তি শুরু করল। বিরোধী সাংসদেরা অম্বেডকরের মূর্তির দিক থেকে পার্লামেন্ট হাউসের দিকে যাচ্ছিলেন। সিঁড়ির কাছে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বিজেপির সাংসদেরা। আমাদের আটকাবেন বলেই দাঁড়িয়েছিলেন। অম্বেডকরকে ওঁরা অসম্মান করেছেন, এটা এ ভাবে ধামাচাপা দেওয়া যাবে না।’’
খড়্গের বর্ণনা
সাংবাদিক বৈঠকে খড়্গে বলেন, ‘‘ওঁরা অশান্তি শুরু করলেন। তার পর আমাদের বিরুদ্ধেই সেই অভিযোগ তুলছেন! ওঁরা বসে বসে আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছিলেন। আমাদের সঙ্গে মহিলা সাংসদেরাও ছিলেন। এটা আমরা সহ্য করব না। শাহের অম্বেডকর-মন্তব্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন জারি থাকবে।’’
‘শরীরের কাছে চলে এসেছিলেন রাহুল’
নাগাল্যান্ড থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ ফাঙ্গনন কন্যাক দাবি করেছেন, রাহুল গান্ধী তাঁর শরীরের কাছাকাছি চলে এসেছিলেন! তাঁর কথায়, ‘‘উনি (রাহুল) আমার কাছে চলে এসে চিৎকার শুরু করেছিলেন। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। একজন সাংসদের থেকে আমি এমন আচরণ আশা করিনি।’’
কী বলেছিলেন শাহ
মঙ্গলবার রাজ্যসভায় সংবিধানের ৭৫ বছর নিয়ে বিতর্কের শেষে জবাবি বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘‘এখন একটা ফ্যাশন হয়েছে, অম্বেডকর, অম্বেডকর, অম্বেডকর, অম্বেডকর...। এত বার ভগবানের নাম নিলে সাত জন্ম পর্যন্ত স্বর্গ লাভ হত।’’ তাঁর আরও সংযোজন, ‘‘জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে অম্বেডকরের অনেক মতপার্থক্য ছিল। সেই কারণেই নেহরুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।’’ বুধবার থেকেই শাহের বিরুদ্ধে অম্বেডকর-অবমাননার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy