পহেলগাম সন্ত্রাসের সুতোয় নিঃশব্দে জড়িয়ে গেল বাংলাদেশ সীমান্তের নিরাপত্তা। সরাসরি সেনা মোতায়েন নয়, তবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে আধাসামরিক বাহিনীর ছায়ায় এখন সেনা-গোয়েন্দাদেরও তৎপরতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে বলে সেনাবাহিনী সূত্রে জানা গিয়েছে।
প্রথম ধাপ হিসেবে, দেশের পাঁচ রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৪,০৯৬ কিলোমিটার বিস্তৃত বাংলাদেশ সীমান্তে আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যৌথ ভাবে ‘কম্প্রিহেনসিভ ইন্টিগ্রেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ (সিআইবিএম)-এর আওতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখার নজরদারি চালানোর ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই সীমান্তের সিংহভাগই পশ্চিমবঙ্গে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, এই বিস্তীর্ণ সীমান্তে কয়েকটি স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট বা কৌশলগত ভাবে সুবিধাজনক জায়গায় ইতিমধ্যেই সেনা তৎপরতা (মিলিটারি ড্রিলস), সেনা গোয়েন্দাদের (মিলিটারি ইনটেলিজেন্স) অনুসন্ধান এবং নির্দিষ্ট কিছু পরিকাঠামো (ইনফ্রাস্ট্রাকচার আপগ্রেডেশন) রদবদলের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। উত্তরবঙ্গের হাসিমারা এবং বাগডোগরা বিমানপোতে উড়িয়ে আনার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বায়ুসেনার রাফাল বিমানকে।
বাংলাদেশ সীমান্তের ৩,১৮০ কিলোমিটারে কাঁটাতারের বেড়া পড়লেও বাকি অংশে কোথাও নদী কোথাও বা খোলা প্রান্তরে ইতস্তত ছড়ানো পিলার। জনবসতের মাঝ বরাবর অদৃশ্য সীমারেখার মাঝে কোথাও বা গ্রামবাসীর রান্নাঘর পড়েছে বাংলাদেশে, বাকি অংশ ভারতের চৌহদ্দিতে। এমনই ‘অসুরক্ষিত’ অঞ্চলে কী ভাবে বেড়া দেওয়া যায়, তা নিয়ে রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে অচিরেই আলাচনায় বসার কথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। সে কাজ রাতারাতি সম্ভব নয়। আপাতত তাই ওই সব এলাকায় নাইট ভিশন ক্যামেরা, সিসিটিভি এবং ড্রোন নজরদারি বাড়ানোর কথা ভাবা হয়েছে বলে সেনা সূত্রে খবর। সরাসরি সেনা নিয়োগের সম্ভবনা না থাকলেও আধা সামরিক বাহিনীর ছায়ায় আপাতত এ ভাবেই চলবে সেনার নজরদারি।
বাংলাদেশের ছত্রচ্ছায়ায় পাকিস্তানের মদতে পুষ্ট বেশ কিছু জঙ্গি যে ক্রমেই তৎপরতা বাড়াচ্ছে, দিন কয়েক আগে সে ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। জানিয়েছিলেন, সীমান্ত জুড়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা শাখা আইএসআইয়ের আনাগোনার কথাও। সতর্ক করা হয়েছিল বিএসএফ কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই সন্ত্রাসের অভিমুখ ঘুরে যায় সুদূর পহেলগামে। সে ব্যাপারে সেনা গোয়েন্দাদের কাছে আগাম খবর না থাকা নিয়ে আঙুলও উঠেছে। তবে সেনা সূত্রে পাল্টা আশ্বাস দিয়ে জানানো হয়েছে, আর কোনও ফাঁক রাখতে চায় না তারা। তাই শুধু পাক সীমান্ত ঘেঁষা কাশ্মীর নয়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পড়শি বাংলাদেশকেও আর ‘আস্থাভাজনের’ তালিকায় রাখতে চাইছে না সেনাবাহিনী। নিরাপত্তার নজরদারিতে তাই মুড়ে ফেলা হবে বাংলাদেশ সীমান্তও।
মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানে সাম্প্রতিক অস্থিরতার জেরে ইতিমধ্যেই সামনে এসেছে বাংলাদেশি এবং পাক-সেনার মদতপ্রাপ্ত জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার কথা। কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে তাদের এ বাংলাতেও পা পড়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। সেই সূত্রে ওই জেলায় বিএসএফ মোতায়েনও বাড়ানো হয়েছে বলে খবর।বাড়ানো হয়েছে আধা সামরিক বাহিনীর ক্যুইক রেসপন্স (কিউআরটি) টিমের সংখ্যা। এমনকি সীমান্তের যে অংশগুলি সীমা সুরক্ষা বল (এসএসবি) কিংবা ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশের (আইটিবিপি) দায়িত্বে রয়েছে, সেই সব বাহিনীকেও ‘ইউনিফায়েড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট’-এর আওতায় এনে এক ছাতার তলায় কাজ করা নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হয়েছে।
শিলিগুড়ির গা ঘেঁষা ‘চিকেন করিডর’ গোয়েন্দা পরিভাষায় ‘ছুপা রাস্তা’ হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া স্বল্প পরিসর ওই জায়গাটি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সুতোর মতো করে যোগসূত্র টিকিয়ে রেখেছে। গত অগস্টে বাংলাদেশে পট পরিবর্তনের পরে, কখনও সমাজমাধ্যমের পোস্টে কখনও বা সরাসরি জনতার মিছিল থেকে, একদা ‘বন্ধু’ দেশের বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মুখে প্রায়ই শোনা গিয়েছে ‘চিকেন করিডর’ দখলের দাবি। কাশ্মীরে জঙ্গি হানার পরে তাই ‘চিকেন করিডর’ জুড়ে এখন সেনাবাহিনীর ‘ত্রিশক্তি কোর’ আর ‘অসমরাইফেলস’-এর ব্যস্ততা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)