কামাখ্যা করিডর প্রকল্প। ছবি: এক্স
কামাখ্যা মন্দিরকে কেন্দ্র করে ‘পিএম ডিভাইন’ ও ‘প্রসাদ’ প্রকল্পের অধীনে কামাখ্যা করিডর তৈরি করতে চলেছে সরকার। উজ্জ্বয়িনীর মহাকাল মন্দির ও কাশী বিশ্বনাথ মন্দির করিডরের আদলেই এ কাজ হবে। কিন্তু ঐতিহ্যক্ষেত্রে ও পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল এলাকায় এ ভাবে নির্মাণযজ্ঞ চালানোয় মন্দির চত্বরের ক্ষতি হবে, এমনকী শুকিয়ে যেতে পারে পারে গর্ভগৃহের জলধারাও- এমনই দাবি করে প্রস্তাবিত কামাখ্যা করিডরের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আবেদন জানালেন বরদেউড়ি নবজ্যোতি শর্মা। হাই কোর্ট বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে হলফনামা দিতে বলেছে। হলফনামা চাওয়া হয়েছে প্রত্নতত্ত্ব দফতর ও পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কাছেও। কারণ, শুনানির পরিপ্রেক্ষিতেই উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কয়েকশো বছরের পুরনো কামাখ্যা মন্দির প্রত্নতত্ত্ব দফতরের নথিভুক্ত প্রত্নস্থল বা পুরাতাত্ত্বিক সৌধের তালিকাতেই নেই! তাই কামাখ্যাকে ঘিরে সরকার কোনও অদলবদল, নতুন নির্মাণ করতে চাইলে শুধুমাত্র আপত্তিই জানাতে পারে প্রত্নতত্ত্ব দফতর। বাধা দেওয়ার অধিকার তাদের নেই।
নবজ্যোতির দাবি, কোনও ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ ছাড়া ও পারিপার্শিক প্রভাবের মূল্যায়ন না করেই ৪৯৮ কোটি টাকার ওই করিডর তৈরির নকশা বানানো হয়েছে। ব্যাপক নির্মাণকাজ চলায় ঐতিহ্যশালী মন্দিরের ক্ষতি হতে পারে। মন্দিরের গর্ভগৃহে বয়ে যাওয়া মূল জলধারাও শুকিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল দেবজিৎ শইকিয়া জানান, প্রস্তাবে স্পষ্ট বলা হয়েছে করিডর প্রকল্প মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করবে না। ইতিমধ্যে পুরো প্রকল্পটি নিয়ে ও সুপ্রাচীন মন্দির চত্বরের সব কাঠামো, শিলালেখ ইত্যাদি নিয়ে বিশদ সমীক্ষাও চালানো হয়েছে। মূল মন্দির-সহ কোনও মন্দিরেরই ক্ষতি করা হবে না। শইকিয়ার দাবি, বরদেউড়ি সমাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলি ও রাজ্য সরকারের বিশদ বৈঠকের পরেই কাজ শুরু হয়েছে। তখন কেউ আপত্তি তোলেনি। কামাখ্যার আশেপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো বহুতল বাড়ি ও হোটেল তৈরি হয়েছে, অন্যান্য নির্মাণ হয়েছে- তা নিয়েও আপত্তি তোলা হয়নি।
পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ অসমের অবসরপ্রাপ্ত অধিকর্তা তথা বর্তমানে নাগাল্যান্ডে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এইচ এন দত্ত কামাখ্যাকে এএসআইয়ের হাতে আনার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তিনি জানান, কামাখ্যা বোর্ড কখনও মন্দিকের প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণে উৎসাহী ছিল না। মন্দিরটি অতীতে এএসআইয়ের তালিকাভুক্ত থাকলেও দেবোত্তর বোর্ডের অসহযোগিতায় এএসআই কোনও কাজই করতে পারেনি। সেখানে অনেক স্বার্থের বিষয় জড়িত। কিন্তু কামাখ্যার মতো ঐতিহ্যক্ষেত্রকে এ ভাবে রূপান্তর করা ঠিক নয়। রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব দফতরের অধিকর্তা দীপিরেখা কৌলি বলেন, কামাখ্যার মন্দির চেষ্টা করেও আমরা হাতে পাইনি। সেখানে কোনও ধরণের নির্মাণ হলে আমরা আপত্তি জানাতে পারি, কিন্তু বাধা দিতে পারি না। উল্লেখ্য, বালাভৈরবী, মহাকাল গণেশ মন্দির, নমথ কালী মন্দির, দুটি শিলালিপি বাদে অন্য কোনও মন্দিরই পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বা প্রত্নতত্ত্ব দফতরের অধীনে নেই।
এই প্রসঙ্গে আবেদনকারীর পক্ষের আইনজীবী উপমন্যু হাজরিকা হাই কোর্টে আর্জি জানান, কামাখ্যা ও তার আশপাশের মন্দিরগুলিকে যেন অবিলম্বে সংরক্ষিত সৌধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মূল কাঠামোর ১০০ মিটার পরিধি নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষিত হোক।
অ্যাডভোকেট জেনারেল জানান, যে এলাকা দিয়ে কামাখ্যা করিডর তৈরি হবে সেই এলাকায় বর্তমানে অপরিকল্পিত আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা রয়েছে। যা মন্দিরের প্রবেশপথকে আবদ্ধ করে দেয় ও দৃশ্যদূষণ করে। তাই করিডর তৈরির সময় ওই অপরিকল্পিত নির্মাণগুলি ভেঙে ফেলা হবে। দর্শনার্থীদের মন্দিরে প্রবেশে সব ধরণের সুবিধা করে দেওয়া হবে। কোনও মন্দিরে হাত পড়বে না। মূল মন্দিরের ১০০ মিটার পরিধি সংরক্ষিত এলাকা হওয়ার দাবি তোলা হলেও সেখানেও এখন অনেক অবৈধ নির্মাণ রয়েছে। তাও ভাঙা হবে।
বিচারপতি সৌমিত্র শইকিয়া গোটা বিষয়টি নিয়ে রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব দফতর, পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ, রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার, পিএম ডিভাইন প্রকল্প কর্তৃপক্ষ, রাজ্য পর্যটন ও সংস্কৃতি দফতরের কাছ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা তলব করেন।
ওই প্রকল্পের বিরুদ্ধে এপ্রিলে গীতিকা ভট্টাচার্য ও আরও ১২ জন একটি জনস্বার্থ মামলাও দায়ের করেন। সরকারের থেকে শ্বেতপত্র দাবি করা হয়। তারও শুনানি চলছে। প্রকল্পে আপত্তি জানিয়ে শুরু হওয়া অনলাইন প্রতিবাদেও কয়েক হাজার মানুষ সই করেছেন।
গীতিকার দাবি, পৌরাণিক মতে এই মন্দিরকে সুরক্ষা দেন চৌষট্টি যোগিনী। তাঁরা বিভিন্ন শিলাখণ্ডের আকারে রয়েছেন। কামাখ্যার পিছনে বরাহ ও বিষ্ণু পর্বতকে কেটে, যোগিনী পথ ধ্বংস করে নতুন রাস্তা তৈরির ফল কী হয়েছে সকলে দেখেছেন। অনেক ধস, দুর্ঘটনা, প্রাণহানির পরে বাধ্য হয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। উন্নয়ন বা পর্যটনের স্বার্থে কামাখ্যা পাহাড়ের ক্ষতিসাধন বিপজ্জনক।
কামাখ্যার প্রবীণ পুরোহিত ভূপেশ শর্মার মতে, গোটা নীলাচল পাহাড় জুড়েই মন্দির ছড়িয়ে এবং শুধু কামাখ্যা নয়, কামেশ্বর, শুক্লেশ্বর, ছিন্নমস্ত, কালী, তারা মন্দিরেও ভিতরে জল বইছে। করিডর করার আগে এখানকার ভূতাত্ত্বিক, পরিবেশগত ও আর্থ-সামাজিক প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা করা প্রয়োজন। এত বড় নির্মাণযজ্ঞে পরিবেশ ও ভূপৃষ্ঠে প্রভাব পড়বেই। শাস্ত্রমতে এখানকার সব শিলায় দেবীর বাস। সাধনার কেন্দ্রকে পর্যটন কেন্দ্র করার প্রয়োজন নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy