প্রতীকী ছবি।
দিনের শেষে পূজা যখন ঘুমোতে যায়, তখনও ওর চোখ-মুখ চকচক করে। আনন্দে নয়, অভ্র-কুচিতে। মাত্র এগারোতেই শৈশব ছুটেছে পূজা ভুরিয়ার। রাত ফুরোলে ঝাড়খণ্ডের এই স্কুলছুট মেয়ে ফের ছুটবে খনিতে। রোজ-রোজ হাতেগরম ২০ থেকে ৩০ টাকা। মন্দ কী! এতেই যে পেট চলছে।
কিন্তু পূজার মতো ঝাড়খণ্ড ও বিহারের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যে ভাবে রোজ প্রাণ হাতে করে অবৈধ অভ্রখনিতে নামছে, তা নিয়েই সিঁদুরে মেঘ দেখাল সুদূর ম্যানহাটনের একটি ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমের তদন্তমূলক প্রতিবেদন। ওই রিপোর্ট বলছে, পূজার মতো শিশু খনিশ্রমিকের সংখ্যাটা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজারে।
সিনেমায় দেখা নায়িকাদের মতো সাজতে ইচ্ছে করে পূজার। কিন্তু সে আর দিচ্ছে কে? অথচ, এদের মতো কচি হাতে খনি ঢুঁড়ে আনা অভ্রই ঝাড়াই-বাছাই হয়ে বারবার হাতবদল হয়ে চলে যাচ্ছে বড় বড় সব প্রসাধনী শিল্প সংস্থায়। তৈরি হচ্ছে দামি-দামি আইশ্যাডো, লিপস্টিক আর ‘ফরসা-হওয়ার’ ক্রিম। মার্কিন প্রতিবেদনটি বলছে, ভারতের বাজারই এখন সব চেয়ে বড়। বিশেষত চিনের মতো দেশে এখান থেকেই ৬০ শতাংশ অভ্র যাচ্ছে। প্রায় চার হাজার শব্দের তদন্ত-রিপোর্টের শিরোনাম— ‘আপনার মেক-আপ বাক্সেই লুকিয়ে প্রসাধনী শিল্পের অন্ধকার দুনিয়া।’ অভ্রর বিপুল চাহিদা রয়েছে আয়ুর্বেদিক ঔষধ এবং ঘর-সাজানোর সামগ্রীতেও।
তাই লাভের কড়ি ঘরে তোলা এই সব সংস্থা কেন বিহার-ঝাড়খণ্ডের এই এলাকার উন্নতির জন্য পাল্টা কিছু করবে না? তদন্ত রিপোর্টে এই প্রশ্নও তুলেছে সংবাদমাধ্যমটি। ফ্রান্সের এক বহুজাতিক প্রসাধনী শিল্প সংস্থা কিন্তু এর উত্তরে বলেছে, অভ্র আমদানি কমিয়ে দিলে বিহার-ঝাড়খণ্ডের ওই সব এলাকার অর্থনীতিই ধসে পড়বে। একমাত্র বৈধ খনিসংস্থা থেকেই তারা অভ্র আমদানি করে বলেও জানিয়েছে বেশির ভাগ সংস্থা।
অভ্র দিয়ে ঠিক কী যে হয়, পূজারা জানে না। শুধু জানে, কাজে যেতে হবে। তাই ঝুঁকি আছে জেনেও রোজ অবলীলায় তারা সেঁধিয়ে যাচ্ছে কানাগলির মতো লিকলিকে সুড়ঙ্গে। সঙ্গে ছেনির মতো একটা যন্ত্র, একটা হাতুড়ি আর ঝুড়ি। যে কোনও মুহূর্তে ধস নামতে পারে খনিতে। তাই সাবধানে, গুটি-গুটি পায়ে। যাচ্ছে, আবার দিনের শেষে ওরা ফিরেও আসছে সর্বাঙ্গে চকচকে অভ্রকুচি মেখে। ফুসফুসেও ঢুকছে বেশ খানিকটা। পূজার মতো এদের সবার ছোট-ছোট হাতে ফোস্কা। এদের পরিবার খুব ভাল করেই জানে, খনিতে এ ভাবে দিনের পর দিন গিয়ে কাজ করতে গিয়ে আহত, পক্ষাঘাতগ্রস্তও হতে পারে বাচ্চারা। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তবু যাচ্ছে, আর কিছু উপার্জন করে ফিরছে— সেটাই বা কম কিসের!
কিন্তু সবাই আর ফিরছে কই! মার্কিন প্রতিবেদনটির দাবি, প্রতি মাসে ধসের কবলে ২০ থেকে ৩০টি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে এই দু’টি রাজ্যে। সেই দিনটার কথা এখনও ভুলতে পারে না দশের নাবালিকা সুরমা কুমারী। তিন বছরের বড় দিদিকে নিয়ে খনিতে ঢুকেছিল সে। তার পর আচমকা ধস নামল। খবর পেয়ে যখন বাড়ির লোক ছুটে এলেন, তত ক্ষণে সুরমার শরীরের অর্ধেকটা ঢুকে গিয়েছে ধ্বংসস্তূপের তলায়। আর দিদি লক্ষ্মীর পুরোটা। এক ঘণ্টার চেষ্টায় যখন বার করে আনা হল, লক্ষ্মী তত ক্ষণে নিথর। পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিল খনি সংস্থা। ব্যস, ওইটুকুই। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, অবৈধ খনিতে এমন দুর্ঘটনায় মৃত্যু আকছার ঘটলেও পুলিশ-প্রশাসনের হেলদোল নেই। ধরাবাঁধা ওই ক্ষতিপূরণ নিয়ে সুরমা-লক্ষ্মীর বাবা এখনও কাজ করছেন ওই একই খনিতে। বলছেন, ‘‘আর তো কিছু পারি না। কী করব?’’ খিদের জ্বালায় জোর করে শোক ভুলতে চাইছেন। তবে ইদানীং খনির অন্ধকারে ঢুকতে বাবার মতোই ভয় পায় ছোট মেয়েটা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy