পেনশনের অঙ্কে নিশ্চয়তা দিতে যে নতুন পেনশন নীতি হাতে নিয়েছিল নরেন্দ্র মোদী সরকার, তা আগামী অর্থবর্ষ (১ এপ্রিল) থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু দু’মাসেরও বেশি আগে, আজ সন্ধ্যায় সেই ‘সমন্বিত (ইউনিফায়েড) পেনশন প্রকল্প’-এর সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করল কেন্দ্রীয় সরকার। যদিও প্রকল্প কার্যকর হওয়ার তারিখ বদল হয়নি, কিন্তু তড়িঘড়ি ওই বিজ্ঞপ্তি জারির পিছনে দিল্লিতে আগামী মাসের গোড়ায় হতে চলা বিধানসভা ভোটের অঙ্ক রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের ফলে সব মিলিয়ে ২৩ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী উপকৃত হতে চলেছেন।
বর্তমান জাতীয় পেনশন প্রকল্প (এনপিএস)-এ অবসরের পরে মাসিক পেনশনের পরিমাণ খুবই নগণ্য হওয়ায় এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছিল কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের মধ্যে। এরই মধ্যে হিমাচলের মতো কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলি রাজ্যের সরকারি কর্মীদের পেনশন দেওয়ার প্রশ্নে এনপিএস-এ ভরসা না রেখে পুরনো প্রকল্পে ফিরে যায়। ফলে সরকারের উপরে ক্রমশ চাপ বাড়ছিল। সেই কারণে গত বছর অগস্টে চার রাজ্যে (হরিয়ানা, জম্মু ও কাশ্মীর, মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ড) বিধানসভা নির্বাচনের আগে নতুন পেনশন নীতি আনার সিদ্ধান্ত নেয় মোদী সরকার। যদিও নতুন সমন্বিত পেনশন প্রকল্প কার্যকর হবে ১ এপ্রিল থেকে। কিন্তু আজ প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্-সন্ধ্যায় ওই প্রকল্পের সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারির মধ্যে ভোটের রাজনীতি লুকিয়ে রয়েছে বলেই মনে করছেন রাজনীতিকেরা। কারণ দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী, দিল্লির সরকারের কর্মী, সামরিক বাহিনী মিলিয়ে প্রায় ৪ লক্ষ সরকারি কর্মী থাকেন। তাঁরা উপকৃত হবেন। দিল্লি সরকারের কর্মীরাও কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন পান। ভোটের আগে এই সিদ্ধান্ত তাঁদের মন জয়ের অব্যর্থ দাওয়াই বলে রাজনৈতিক শিবিরের ব্যাখ্যা।
সমন্বিত পেনশন প্রকল্পে বলা হয়েছে, কোনও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী যদি অন্তত পঁচিশ বছর চাকরি করেন, সে ক্ষেত্রে অবসরের আগের শেষ ১২ মাস তিনি যে ‘বেসিক পে’ বা মূল বেতন পেতেন, তার ৫০ শতাংশ অর্থ নিশ্চিত পেনশন হিসেবে পাবেন। পেনশন প্রাপকের মৃত্যুর পরে পরিবার প্রাপ্ত পেনশনের ৬০ শতাংশ করে পাবে। এ ছাড়া নতুন নিয়মে কোনও সরকারি কর্মী যদি অন্তত দশ বছরের চাকরি জীবনের মেয়াদ শেষ করেন, তা হলে তিনি ন্যূনতম দশ হাজার টাকা করে পেনশন পাবেন।
এ ছাড়া অবসরের সময়ে গ্র্যাচুইটি ছাড়াও থোক টাকা পাবেন অবসর নেওয়া কর্মী। অবসরের সময়ে মাসিক মূল বেতন ও মহার্ঘ ভাতা মিলিয়ে যে টাকা ওই ব্যক্তি পান, তার দশ ভাগের এক ভাগ টাকা দেওয়া হবে প্রতি ছয় মাস কর্মজীবনের জন্য। এ ছাড়া মূল্যবৃদ্ধির সূচকের ভিত্তিতে কারখানার কর্মীদের যে হারে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয়, পেনশন প্রাপকদের সেই সূত্র মেনেই মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে।
কেন্দ্রের দাবি, এই নতুন নীতি হাতে নেওয়ার ফলে কর্মীদের পেনশন খাতে এককালীন অর্থ দিতে প্রায় আটশো কোটি টাকা খরচ হবে। ওই নীতি হাতে নেওয়ায় সরকারের কর্মী পিছু পেনশন খাতে অর্থ সাহায্যের পরিমাণ ১৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮.৫ শতাংশ হতে চলেছে। কর্মীরা আগের এনপিএস ব্যবস্থাতেও থাকতে পারেন, অথবা নতুন এই পেনশন প্রকল্প বেছে নিতে পারেন। রাজ্য সরকারগুলি চাইলে নিজেদের রাজ্যে সমন্বিত পেনশন প্রকল্প চালু করতে পারে। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে প্রায় ৯০ লক্ষ সরকারি কর্মচারী ওই নতুন প্রকল্পের ফায়দা পাবেন।
পুরনো পেনশন ব্যবস্থায় অবসরের সময়ে মূল বেতনের অর্ধেক পরিমাণ পাওয়া নিশ্চিত ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার এই এনপিএস ব্যবস্থা চালু করে। কিন্তু এনপিএস ব্যবস্থায় পেনশনের পরিমাণ খুব কম হওয়ায় এ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হওয়া এবং লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কাকে মাথায় রেখে নতুন পেনশন প্রকল্প হাতে নেয় কেন্দ্র। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ এখনও পুরনো (২০০৪ সালের আগের) পেনশন প্রথায় রয়ে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নতুন সমন্বিত পেনশন প্রকল্পকে গ্রহণ করে কি না, তা-ই এখন দেখার।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)