প্রতীকী ছবি।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ-র মাধ্যমে প্রতিবেশী তিন মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে আসা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেবে ভারত। আইন প্রণয়নকারী এবং সমর্থনকারীদের বক্তব্য, এই সিদ্ধান্ত উস্বাস্তু তথা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব সমস্যার স্থায়ী সমাধান দেবে। এ দেশের মুসলিম নাগরিকদের একাধিক বার বিভিন্ন মঞ্চ থেকে আশ্বস্ত করেছেন নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কি সত্যিই আশ্বস্ত করতে পারছে এ দেশের সংখ্যালঘুদের? এ দেশের নাগরিকদের অন্য দেশে আশ্রয় চাওয়ার সংখ্যা কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে।
নাগরিকত্ব আইনে সদ্য হওয়া সংশোধনের আগেই, ভিনদেশে ভারতীয় শরণার্থী এবং শরণার্থী হতে চাওয়া ভারতীয়ের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। মোদী জমানায় স্বঘোষিত গোরক্ষকদের বাড়বাড়ন্ত, গোমাংস বিক্রি কিংবা বহন করার ‘অপরাধ’-এ হত্যা-গণপিটুনি, কখনও জয় শ্রীরাম না বলায় মারধর-খুনের মতো ঘটনা বেড়েছে। ধর্ম-সংস্কৃতির এই ধ্বজাধারীদের দাপটে কি পরিত্রাণের পথ খুঁজছে মুসলিম সম্প্রদায়?
শরণার্থী কাদের বলা হবে? আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অন্য কোনও কারণে অত্যাচারিত হলে, তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে এবং রাষ্ট্র তাঁর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে তিনি শরণার্থী বা উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য হতে পারেন। আর এই আইনেই সারা বিশ্বে আশ্রয়প্রার্থী এবং শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত ভারতীয়র সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বহু দেশের সাম্প্রতিক উদ্বাস্তু তালিকা ও আবেদনকারীর সংখ্যা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, উগ্র হিন্দুত্বের বাড়াবাড়িতে, অত্যাচারের ভয়ে দেশ ছেড়ে অন্যান্য দেশে আশ্রয়প্রার্থী এবং আশ্রয়প্রাপ্তদের সংখ্যা গত দু’বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। অনেকেরই আতঙ্ক, ভারত এক সময় হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
এখনও অবশ্য ব্যাপক হারে উদ্বাস্তু সঙ্কটের ছবিটা নেই। কিন্তু যে হারে হিন্দু জাতীয়তাবাদের স্বর চড়ছে, তাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই দেশ ছেড়ে অন্য রাজ্যে এবং বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়ার পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন। এমনটাই মনে করছেন সারা বিশ্বে উদ্বাস্তু সঙ্কট নিয়ে কাজ করা একাধিক বিশেষজ্ঞ।
রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী কমিশনের রিপোর্টেও দীর্ঘ হচ্ছে ভারতীয় উদ্বাস্তু-শরণার্থীর তালিকা। রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভারতীয় উদ্বাস্তুর সংখ্যা ছিল ৯,৬০২ জন। শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ের আবেদন ঝুলে রয়েছে ৫১ হাজার ৮১২ জনের। ২০১৬ সালের এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে ২৪ শতাংশ বেড়েছে শরণার্থীর সংখ্যা। আবেদনকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৬ শতাংশ। আমেরিকা-কানাডা ছাড়াও ভারতীয়দের আশ্রয় চাওয়ার তালিকায় উপরের দিকে রয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকা (৪৩২৯), অস্ট্রেলিয়া ৩৫৮৪, ইংল্যান্ড (১৬৬৭) দক্ষিণ কোরিয়া (১৬৫৭) এবং জার্মানি (১৩১৩)।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
আবার রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী কমিশনের ১০ বছরের রিপোর্ট খতিয়ে দেখলে বিষয়টা আরও উদ্বেগের। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আশ্রয় চেয়ে আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে ৯৯৬.৩৩ শতাংশ। এবং এই সব আবেদনকারীদের একটা বড় অংশই কারণ হিসেবে ভারতে বসবাস করতে ভয় পাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেছেন। ২০০৯ সালে এই আবেদনের সংখ্যা ছিল ৪৭২২, ২০১৮ সালে যা বেড়ে হয়েছে ৫১৭৬৯।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
কিন্তু এর কারণ কী? কেন দেশ ছাড়তে চাইছেন ভারতীয় সংখ্যালঘুরা? কারণ অবশ্য নানা রকম। ২০১৩ সালে আমেরিকার স্বরাষ্ট্র দফতর শরণার্থী হিসেবে ভারতীয়দের ঝুলে থাকা আবেদনগুলি গভীর ভাবে খতিয়ে দেখেছিল। তাতে উঠে এসেছিল— শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, উগ্রপন্থা, নারীবিদ্বেষ, এলজিবিটি বিদ্বেষের মতো ঘটনার জন্য তাঁরা আমেরিকায় আশ্রয় চেয়েছিলেন। সেই সময় সারা ভারতের যত আবেদনকারী ছিলেন, শুধু পঞ্জাবের সংখ্যাই তার চেয়ে বেশি ছিল। তাঁদের আশ্রয় চাওয়ার কারণ ছিল অর্থনৈতিক মন্দা, মাদক, পরিবেশগত সমস্যা এবং রাজনৈতিক উত্তেজনার মতো বিষয়। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অধিকাংশেরই আবেদন খারিজ হয়ে যায়, কারণ শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার মতো পোক্ত কারণ তাঁদের ছিল না। ওয়াশিংটনের বক্তব্য ছিল, এই আবেদনকারীরা ভারতেরই অন্য কোনও রাজ্যে আশ্রয় নিতে পারেন।
কিন্তু গত দু’বছরে ধর্মীয় কারণটা বড় হয়ে গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডে আশ্রয়প্রার্থী ভারতীয়দের অধিকাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তাঁরা প্রায় সবাই হয় ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়েছেন অথবা অত্যাচারের আশঙ্কা করে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদের সুর চড়া হওয়ায় তাঁরা আতঙ্কিত।
ভারতে সিএএ-এনআরসি-র প্রতিবাদে পথে নেমেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন। - ফাইল চিত্র
উদ্বাস্তু বিশেষজ্ঞ সুরজ গিরিরাজশঙ্কর সম্প্রতি দ্য ওয়ারে একটি প্রতিবেদনে এই উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন। জিন্দাল গ্লোবাল ল’ স্কুলের অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন বিশেষজ্ঞ সুরজ এক সময় রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী কমিশনে মিশর ও তুরস্কে কাজ করেছেন। তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি দাবি করেছেন, ভারত থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে বা অত্যাচারের ভয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগের নজির বাড়ছে। বাড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় বা নাগরিকত্ব চাওয়া ভারতীয়েরর সংখ্যা।
এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চাওয়া ভারতীয়দের আবেদনপত্র থেকেও উঠে এসেছে এই ধর্মীয় কারণে অত্যাচার বা আতঙ্কের কথা। মহারাষ্ট্রে গোমাংসের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এক ব্যবসায়ী সম্প্রতি কানাডায় আশ্রয় চেয়েছিলেন। তাঁর দাবি খতিয়ে দেখে কানাডা সরকারের বক্তব্য, ‘‘২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গোরক্ষকরা আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং তাঁদের কার্যকলাপে পরোক্ষে বা কখনও সরাসরি সরকারের মদত রয়েছে।’’
অসমে এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি না, তা দেখতে ভিড়। -নিজস্ব চিত্র
এক ভারতীয় হিন্দু মহিলা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম যুবককে বিয়ে করার পর অস্ট্রেলিয়ায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পেয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ারও বক্তব্য, ‘‘(ভারতে) ২০১৪ সালের মে মাসে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি ঘনিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ভিন ধর্মে বিয়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।’’ ভারতীয় এক সমকামীকেও শরণার্থীকেও আশ্রয় দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। সে ক্ষেত্রেও যুক্তি প্রায় একই। প্রায় একই ধরনের নজির রয়েছে নিউজিল্যান্ডেও। কেরলের একটি পরিবার হিন্দু ধর্ম ছেড়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। শরণার্থী হিসেবে নাগরিকত্বের আবেদনের কারণ হিসেবে আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির অত্যাচারের ভয়ের কথা উল্লেখ করে ওই পরিবার। নিউজিল্যান্ড সরকারও তাঁদের সেই আর্জি মেনে নিয়েছে। সরকারি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে।
ফলে ভারতীয় সংখ্যালঘুরা আতঙ্কিত হয়ে ভিন দেশে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু তার চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হল, অন্য দেশগুলিও ধর্মীয় অত্যাচার বা ধর্মীয় কারণে আতঙ্কের বিষয়টি মেনে নিচ্ছে এবং আশ্রয় দিচ্ছে। মোদী জমানায় এই ধরনের বাড়ছে বলেও মতপ্রকাশ করছে বহু দেশ। এটা বিশ্ববাসীর কাছে ভারত তথা মোদী সরকারের পক্ষে যেমন অস্বস্তিকর, তেমনই আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের ভাবমূর্তির জন্যও ভাল বার্তা নয় বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশ।
যদিও এই সব ভারতীয়রা এই উগ্র হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি এবং ধর্মীয় কারণে অত্যাচারের শিকার হয়েই যে দেশ ছেড়েছিলেন এটা নিশ্চিত করে বলা শক্ত। তবে তাঁরা যে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারের আশঙ্কায় ভীত-সন্ত্রস্ত, এটা মেনে নিচ্ছে বহু দেশ। আবার এটাও ঠিক যে, এই সব আবেদনই করা হয়েছিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন কার্যকরী হওয়া, অসমে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ এবং জম্মু কাশ্মীরে ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের অনেক আগে। এই তিন বিষয়ে উদ্বেগ আরও বেড়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাই শরণার্থী হিসেবে আবেদনকারীর সংখ্যাটা আরও বাড়তে পারে বলেই আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy