বসুন্ধরা রাজে। —নিজস্ব চিত্র।
তিনি আজ কোথায়? কাল কোথায় প্রচারে যাবেন? কোথায় তাঁর দেখা পাওয়া যাবে? কখন তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ মিলতে পারে?
জয়পুরে সর্দার পটেল মার্গে রাজস্থানের রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে এ সব প্রশ্নের কারও কাছে কোনও উত্তর নেই। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ কবে রাজস্থানে কোথায় প্রচার করবেন, তা সবাই গড়গড়িয়ে বলে দেবেন। কিন্তু গুগল ম্যাপে বসুন্ধরা রাজের ‘লোকেশন’ কী? কারও জানা নেই। সবাই দেখিয়ে দেবেন সিভিল লাইন্সের ১৩ নম্বর বাংলো।
জয়পুরের শাহি মহল্লায় বসুন্ধরা রাজের সরকারি বাংলো। রাজস্থানে দু’দফায় দশ বছর রাজত্ব করে ফেলা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন। সেখানেও একই হাল। একজন বলবেন, বিজেপির দফতরে গিয়ে দেখুন। অন্য জন বলবেন, ওঁর বিধানসভা কেন্দ্র ঝালরাপাটনে খোঁজ নিন। আর একজন বলবেন, উনি তো খুবই ব্যস্ত। গোটা রাজ্যে প্রচার করছেন। সকালে বেরিয়ে পড়ছেন। রাতে বাড়ি ফিরে নিয়মমাফিক দু’ঘণ্টা পুজোয় ব্যস্ত থাকছেন। তার পরে আর সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করার সময় কোথায়?
রাজস্থানে রাজনীতিতে ঢোলপুরের মহারানি বসুন্ধরা রাজে বরাবরই ‘রহস্যময়ী’। এ বার বিধানসভা নির্বাচনে তিনি কার্যত ‘চলমান অশরীরী’র মতো বিচরণ করছেন। নিজের প্রয়োজন ছাড়া কোনও ভাবেই সাংবাদিকদের কাছে ধরা দিচ্ছেন না। কারণ তিনি জানেন, সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে তাঁকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে— নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ কেন আপনাকে রাজস্থানে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করলেন না? বিজেপি ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলে কি আপনি মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবি জানাবেন?
একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে কংগ্রেসের সচিন পাইলটকেও। তিনি নিজের মতো উত্তর দিচ্ছেন। বসুন্ধরা বিজেপিতে থেকেও আরএসএস-কে বিশেষ পাত্তা দেননি। বিজেপি নেতৃত্বের কথায় উগ্র মেরুকরণের রাজনীতি করেননি। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের কথাতেও তিনি ওঠবোস করেন না। তিনি এ সব প্রশ্নের মুখে পড়তেই নারাজ।
তা হলে বসুন্ধরা কী করছেন?
জয়পুরে বিজেপির দফতর হোক বা সেখান থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে ঝালাওয়াড় জেলায় বসুন্ধরার বিধানসভা কেন্দ্র ঝালরাপাটন— বিজেপির অন্দরমহলে কান পাতলে একটাই কথা শোনা যাচ্ছে। তা হল, মোদী-শাহ তাঁকে কোণঠাসা করতে চাইলেও তিনি আসলে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ারই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মহারানি বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মরুভূমি ছাড়তে নারাজ। গোটা রাজ্যে তিনি প্রচার করছেন ঠিকই। তবে শুধু নিজের অনুগামী বিধায়কদের হয়ে। যাতে তাঁরা সবাই জিতে আসতে পারেন। তা হলে ভোটের পরে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে অনুগামী বিধায়করা তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রী করার দাবি তুলবেন।
রাজস্থান বিজেপির এক নেতা বলেন, ‘‘পাঁচ বছর আগের ভোটে কী হয়েছিল? ২০০ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ১০০ আসন জিতল। সরকার গড়তে ছোটখাটো দলের সঙ্গে নির্দল বিধায়কদের সমর্থন দরকার পড়েছিল। ১৩ জন নির্দল বিধায়কের মধ্যে ১০ জন কংগ্রেসকে সমর্থন করলেন। তাঁদের শর্ত ছিল, সচিন পাইলট নয়, অশোক গহলৌতকে মুখ্যমন্ত্রী করতে হবে। তাঁরা আসলে গহলৌতেরই অনুগামী কংগ্রেস নেতা। টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসেবে লড়ে জিতে এসেছিলেন। এ বারের ভোটে আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রথম প্রার্থী তালিকায় বসুন্ধরার অনুগামীদের টিকিট দিতে চাননি। কিন্তু তাঁরা পরে নির্দল হিসেবে জিতে এসে সমস্যা তৈরি করবেন বুঝে পরের দুই প্রার্থী তালিকায় বসুন্ধরার অনুগামীরা টিকিট পেয়েছেন। এখন বসুন্ধরা তাঁদের হয়েই প্রচার করছেন।’’
গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া রাজার মেয়ে বসুন্ধরার বিয়ে হয়েছিল রাজস্থানের ঢোলপুরের রাজার সঙ্গে। তাঁকে কোণঠাসা করে বিজেপি জয়পুরের রাজপরিবারের ‘প্রিন্সেস’ দিয়া কুমারীকে বিধানসভা ভোটের ময়দানে নামিয়েছে। সেই দিয়া কুমারীর হয়ে প্রচারের কাজ করলেও জয়পুরের বিজেপি নেতা, অবসরপ্রাপ্ত বন দফতরের অফিসার ধর্মেন্দ্র রাঠৌর বলছেন, “বসুন্ধরা রাজে দু’বার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। তাঁর ঠিক নরেন্দ্র মোদীর মতোই বড় মাপের পরিকল্পনা করার দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। যোগ্যতায় উনি সকলের থেকে এগিয়ে।’’ রাঠৌরের মতে, বসুন্ধরা রাজস্থান বিজেপির সবথেকে জনপ্রিয় মুখ। তিনি মোদীর মতোই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কঠোর হাতে নেতৃত্ব দিতে পারেন। তার সঙ্গে রাজপরিবারের রক্ত রাজস্থানে বাড়তি দাম পায়।
ঝালাওয়াড় ও ঝালরাপাটন, রাজস্থানের দুই যমজ শহর তৈরি হয়েছিল ঝালা রাজপুত রাজাদের আমলে। ঝালরাপাটনের বিধায়ক হিসেবে বসুন্ধরা দুই শহরেরই ভোল পাল্টে দিয়েছেন। বসুন্ধরার ছেলে দুষ্যন্ত সিংহও ওই এলাকা থেকেই সাংসদ। তারও সুফল মিলেছে। ঝালাওয়াড়ের লোক একসময় শহরের দুর্দশা বোঝাতে বলতেন, ‘জিন্দেগি ঝালাওয়াড় হো গয়ি।’ এখন ভোল পাল্টে সেই ঝালাওয়াড় ও ঝালরাপাটনই রাজস্থানের বাকি শহরকে টেক্কা দিচ্ছে।
এই ঝালাওয়াড়ে প্রচারে দুষ্যন্তের বক্তৃতার পরে বসুন্ধরা বলে ফেলেছিলেন, ছেলে এত উন্নতি করেছে যে তিনি নিশ্চিন্তে অবসর নিতে পারেন। তার অন্য অর্থ হচ্ছে বুঝতে পেরে আবার নিজেই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, ওটা ছেলের গর্বে মায়ের মুখের কথা। আগামী পাঁচ বছর তিনি রাজনীতিতেই থাকবেন। অবসরের ভাবনা নেই।
বিজেপি রাজস্থানে ক্ষমতায় এলে মোদী-শাহ কাকে মুখ্যমন্ত্রী করতে চাইবেন? অনেক নাম ভেসে বেড়াচ্ছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি চন্দ্রপ্রকাশ জোশী, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা রাজেন্দ্র সিংহ, ও পি মাথুর, সতীশ পুনিয়া। তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গজেন্দ্র সিংহ শেখাওয়াত, অশ্বিনী বৈষ্ণব, অর্জুনরাম মেঘওয়ালের নামও রয়েছে। সাংসদদের মধ্যে দিয়া কুমারীর সঙ্গে বাবা বালকনাথের নামও জল্পনায় রয়েছে। নাথ সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু বলে তাঁকে অনেকে রাজস্থানের যোগী আদিত্যনাথ বলেও ডাকছেন। কোটার সাংসদ, লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার নামও রয়েছে। এঁদের বাদ দিয়ে আরএসএস সংগঠনে নীরবে কাজ করে চলা প্রকাশ চন্দ্রকে সামনে নিয়ে এসে চমক দেওয়া হতে পারে বলেও অনেকের ধারণা।
ঝালরাপাটনে বসুন্ধরার এক ঘনিষ্ঠ বিজেপি নেতা এ সব শুনে মুচকি হাসলেন। তার পর বলেন, ‘‘মেওয়াড়ের মহারানা প্রতাপের রাজতিলক বা রাজ্যাভিষেক হয়েছিল উদয়পুরের গোগুন্দা-য়। হলদিঘাটির কাছে সেই রানা প্রতাপের রাজতিলক স্থল থেকেই এ বার বসুন্ধরারাজে প্রচার শুরু করেছেন। বাকিটা বুঝে নিন!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy