রাজস্থানে ভোটপ্রচারে বিজেপির দিয়া কুমারী। —নিজস্ব চিত্র।
আপনার মধ্যে মানুষ মহারানি গায়ত্রী দেবীর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। উনিই কি আপনার অনুপ্রেরণা?
রাজস্থানে ‘ইলেকশন কভারেজ’-এ আসা বাঙালি সাংবাদিকের থেকে প্রশ্নটা যেন প্রত্যাশিতই ছিল। দিয়া কুমারী তাই চমকালেন না।
ঠোঁটের উপরে, কপালের পাশে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সামনে মহিলাদের ভিড়। অনেকে শুধু সামনে থেকে চাক্ষুষ দেখতে এসেছেন। রাজকন্যাকে কাছে পেয়ে কেউ ছুঁয়ে দেখছেন। নিজস্বীর সুযোগ হাতছাড়া করছেন না। বাঁ হাতের মোবাইল ও জয়পুরি সিল্কের শাড়ির আঁচল সামলে জয়পুরের এ-মহল্লা থেকে ও-মহল্লায় প্রচারে ছুটছেন জয়পুরের রাজকুমারী।
বাংলার কোচবিহার রাজপরিবারের মেয়ে গায়ত্রী দেবীর বিয়ে হয়েছিল জয়পুরের মহারাজা দ্বিতীয় মান সিংহের সঙ্গে। আমের ফোর্ট, জয়গড় ফোর্ট, সিটি প্যালেসের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে মহারানি বাষট্টি সালে রাজনীতিতে নেমেছিলেন। জয়পুর থেকে লোকসভার সাংসদ হয়েছিলেন। পর পর তিন বার। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করে তিহাড় জেলে আটকও থেকেছেন। গোলাপি শহর তাঁর রূপের ছটা, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের সাক্ষী। ছয় দশক পরে তাঁর নাতনি রাজকুমারী দিয়া কুমারী জয়পুরের রাস্তায় ভোটের প্রচার করছেন। তাঁরও আচরণে রাজ ঘরানার আভিজাত্য, পরিশীলিত রুচিবোধ ফুটে উঠছে। গায়ত্রী দেবীর সঙ্গে তুলনা নিয়ে প্রশ্নটা তাই আসতই।
দিয়া কুমারীর উত্তরও তৈরিই ছিল— “দেখুন গায়ত্রী দেবী জয়পুরের রাজ ঘরানার আইকন। উনি শুধু সৌন্দর্য ও রুচিবোধের জন্য বিখ্যাত ছিলেন না। রাজনৈতিক ক্ষমতাও অর্জন করেছিলেন। স্বতন্ত্র পার্টিতে যোগ দেওয়ার পরে রেকর্ড ভোটে জিতে সাংসদ হয়েছেন। ওঁর মহিলাদের ক্ষমতায়নের কাজ আমার অনুপ্রেরণা। ওঁর দেখানো পথে আমিও মহিলাদের উন্নয়ন, ক্ষমতায়নের চেষ্টা করছি। উনি জয়পুরের মেয়েদের জন্য স্কুল খুলেছিলেন। আমিও জয়পুরে দু’টো স্কুল খুলেছি, যার সুনাম গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।”
গায়ত্রী দেবীর নাতনি হলেও দিয়ার সঙ্গে তাঁর রক্তের সম্পর্ক নেই। মহারানি গায়ত্রী দেবী ছিলেন মহারাজা দ্বিতীয় মান সিংহের তৃতীয় স্ত্রী। মহারাজার প্রথম স্ত্রীর কোলেই তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ভবানী সিংহের জন্ম। সেই ভবানী সিংহেরই মেয়ে দিয়া কুমারী। বিজেপির হাত ধরে রাজনীতিতে নেমেছেন দশ বছর আগে। প্রথমে সওয়াই মাধোপুর থেকে বিধায়ক। তার পরে গত লোকসভা নির্বাচনে এখন রাজসমন্দের সাংসদ। সাংসদ পদের মেয়াদ ফুরোনোর আগেই নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ তাঁকে রাজস্থানের বিধানসভা ভোটে জয়পুরের বিদ্যাধর নগর থেকে প্রার্থী করে দিয়েছেন।
এমনিতেই ঢোলপুরের মহারানি, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজেকে এ বার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে রাজস্থানের ভোটে লড়ছে না। বিজেপি শিবিরের গুঞ্জন, রাজ ঘরানার কাঁটা দিয়েই কাঁটা তোলা হচ্ছে। ঢোলপুরের মহারানিকে আরও কোণঠাসা করতে জয়পুরের রাজকুমারীকে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে। জয়পুরে গুঞ্জন ছড়িয়েছে, বিজেপি ক্ষমতায় ফিরলে আর বসুন্ধরা নয়, দিয়া কুমারী মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হয়ে উঠতে পারেন।
এ সব নিয়ে প্রশ্ন করলে হেসে এড়িয়ে যান দিয়া কুমারী। নিন্দুকেরা বলে, তিনি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ‘হাতের পুতুল’। শুনে চোয়াল শক্ত হয় দিয়ার। তিনি সোনার পালঙ্কে শুয়ে থাকা রাজকুমারী নন। রাজ ঘরানার ঐতিহ্য ভেঙে রাজ পরিবারের বাইরের নরেন্দ্র সিংহকে বিয়ে করেছিলেন। রাজত্ব লোপ পেলে এখনও রাজস্থানের রাজ পরিবারের ছেলেমেয়েদের অন্যান্য রাজপরিবারেই বিয়ে হয়। দিয়া এই ছক ভেঙেছিলেন। গোটা রাজপুত সমাজ খেপে উঠেছিল। খুন-অপহরণের হুমকি, ধর্মান্তরণের চাপ, সামাজিক বয়কটের ভয়, সর্বোপরি বাবা-মায়ের চাপ, কোনও কিছুতেই দিয়া পিছু হটেননি। চব্বিশ বছর পরে তাঁর বিয়ে ভেঙে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু এখন রাজ পরিবারের ট্রাস্টের সমাজসেবার কাজ, তিনটি স্কুল, জয়পুর-মাউন্ট আবুতে তিনটি হেরিটেজ হোটেল তিনিই সামলান। রাজপুতদের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও তিনি এখন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে।
এই রাজপুতদের ভোট জিততেই এক সময়ে বসুন্ধরা দিয়া কুমারীকে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন। দুই রাজ ঘরানার রাজকন্যার মধ্যে ঠোকাঠুকি লাগাটা অবশ্য ভবিতব্য ছিল। বসুন্ধরা মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় দিয়াদের রাজমহল প্যালেস হোটেলের বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নির্দেশ দেন। তাতে নাকি রাজপুতদের অসম্মান করা হয়েছিল! দিয়া, তাঁর মা মহারানি পদ্মিনী দেবী মিলে বসুন্ধরা-সরকারের বিরুদ্ধে করণী সেনার মতো রাজপুত সংগঠনকে নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। বসুন্ধরা আর দিয়ার মধ্যে তিক্ততা সেই থেকে আর মেটেনি।
বিজেপি এ বার বসুন্ধরারই অনুগামী, বিদ্যাধর নগরের তিন বারের বিধায়ক নরপত সিংহ রাজভীকে সরিয়ে দিয়াকে প্রার্থী করেছে। মহারানি ও রাজকুমারীর ফাটল আরও বেড়েছে। নরপত আবার প্রয়াত উপরাষ্ট্রপতি, একদা রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ভৈঁরো সিংহ শেখাওয়াতের জামাই। রাজকুমারীর নাম শুনলেই তিনি চটে গিয়ে বলছেন, জয়পুরের রাজারা তো মুঘলদের সেনাপতি ছিল। ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করেছিল। দিয়া কুমারীর পূর্বসূরিরা আকবরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মহারানা প্রতাপের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন!
এ নিয়ে প্রশ্ন করলে দিয়া কুমারী নীরবে বুঝিয়ে দেন, এ সবের উত্তর দিতে তাঁর শিক্ষা, রুচিতে বাধে। মহারানি গায়ত্রী দেবীর থেকে পাওয়া শিক্ষা তুলে ধরে বলেন, “আমি ওঁর থেকে একটা জিনিস শিখেছিলাম— নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষের সেবা করা। উনি সব সময় নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে মানুষের জন্য কাজ করতেন। আমারও সেটাই প্রধান লক্ষ্য।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy