নীতীশ কুমার। ছবি পিটিআই।
“স্যর, জাহাঙ্গির লাগলে বলবেন!”পটনায় পৌঁছে সবে হোটেলের ঘরে পা দিয়েছি, তখনই ফিসফিসিয়ে উঠল হোটেল কর্মীর গলার স্বর। অশোকের দেশে জাহাঙ্গিরের কথা ওঠায় আমার হতভম্ব দশা দেখে ফের গলার স্বর খাদে নিয়েই তিনি বললেন, ‘‘মদের কথা বলছি। যদি লাগে, বলবেন।’’
মনে পড়ে গেল, ২০১৫ সালে নীতীশ কুমার ক্ষমতায় এসে রাজ্যে মদ বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। দেশের দ্বিতীয় ড্রাই স্টেট হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে বিহার। কিন্তু নেশাড়ুরা তা শুনবে কেন! সরকারি ভাবে মদ বন্ধ হতেই কালোবাজারি শুরু হয়ে গিয়েছে। তৈরি হয়েছে বিভিন্ন কোড নেম। জাহাঙ্গির, গফুর, ফ্রুটি। কোডের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ। এর মধ্যে জাহাঙ্গির ও গফুর মানে দেশীয় ভাবে তৈরি মদ। আর ফ্রুটি মানে ইন্ডিয়ান মেড ফরেন লিকার। নেপাল মানে দিশি মদ। আর ছোটা সিরাপ কিংবা বড়া সিরাপে বোঝানো হয় বোতলের মাপ। যা চাইছেন, এক ফোনে বাড়িও পৌঁছে যায়।
তবে স্থানীয়দের মতে, চেনাশোনা না থাকলে কেনার ঝুঁকি রয়েছে। মদ তো পৌঁছবে, তার দশ মিনিট বাদে পৌঁছবে পুলিশ। পুরোটাই গড়াপেটার খেলা। সেই পরিস্থিতিতে জেলহাজত এড়াতে কয়েক গুণ টাকা দিয়ে পুলিশের মুখ বন্ধ করা তখন একমাত্র উপায়। যার সুযোগে গত তিন-চার বছরে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন এক শ্রেণির পুলিশকর্মী। পাঁচ বছর আগেও যাঁদের একতলা বাড়ি ছিল, তাঁরা তিন মহলা বাড়ি হাঁকিয়েছেন। কেউ বা ফি বছর সপরিবার বিদেশ ভ্রমণ করতে গিয়ে দুর্নীতি দমন শাখার তদন্তের মুখে পড়েছেন।
আরও পড়ুন: মোদীর ‘যুবরাজ’ কটাক্ষে পাল্টা নিশানা তেজস্বীর
আরও পড়ুন: বিহারেও পুলওয়ামা অস্ত্র মোদীর, সঙ্গে রামমন্দির
‘‘গত চার বছরে মদ বন্ধের কারণে যারা লাভবান হয়েছে, তারা হল বিহার পুলিশ,’’ জানালেন ওলা-চালক প্রকাশ কুমার। তাঁর কথায়, যারা নেশা করার তারা করবেই। আটশো টাকার হুইস্কির বোতল ইদানীং এখানে আড়াই হাজারে বিক্রি হয়। নির্বাচনের সময় সেটিই বিক্রি হচ্ছে তিন হাজারের উপরে।
বিরোধীদের মতে, মহিলা ভোটের কথা ভেবে মদ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও গোটা বিহার জুড়ে বেআইনি মদের ব্যবসা পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করছেন জেডিইউ-এর কিছু নেতা। প্রত্যেকের আলাদা এলাকা ভাগ করা রয়েছে। ওই এলাকায় নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে মদ কেনাবেচা করলে ধরা পড়ার ভয় নেই। এলজেপি নেতা চিরাগ পাসোয়ানের দাবি, ‘‘সবাই সব জানে। কেউ কিছু করে না। গোটা রাজ্যে মদ মিলছে। আসলে মদ বন্ধ করে পুলিশ এবং দলের নেতাদের টাকা রোজগারের পথ খুলে দিয়েছেন নীতীশ কুমার।’’
তা হলে উপায়? ঘটনা হল, মদের ব্যবসা বন্ধ করা নিয়ে আপত্তি যতই থাক, সে কথা আরজেডি-সহ বিরোধীরা কেউই সরাসরি বলতে পারছে না। তাদের আশঙ্কা, সরাসরি মদ ফিরিয়ে আনার কথা বললে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে মহিলা-সহ ভোটারদের একাংশের মনে। কিন্তু যেহেতু এত দিন যাদব ও রাজপুতেরা বিহারে মদের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে, তাই তাদের সমর্থনের কথা ভেবে ধাপে ধাপে মদের ব্যবসা শুরু করা হবে বলে প্রচার চালাচ্ছেন তেজস্বীরা। অন্য দিকে জেডিইউ নেতাদের অভিযোগ, মদের ব্যবসা হাত থেকে চলে যাওযার দুঃখ ভুলতে পারছেন না আরজেডি নেতারা। তাই তাঁরা তলে তলে মদ বিক্রি চালু করার জন্য সওয়াল করে যাচ্ছেন।
মদ বন্ধ করা নিয়ে নীতীশের সিদ্ধান্তে মহিলারা খুশি হলেও, পুরুষদের একটি বড় অংশ কিন্তু ক্ষুব্ধও। সেই ক্ষোভকে খুব কৌশলে নীতীশের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চাইছেন আরজেডি নেতৃত্ব। মদ বন্ধ হওয়ার পর চোলাই মদ খেয়ে ইতিমধ্যেই গত চার বছরে মারা গিয়েছেন কয়েকশো মানুষ। তাঁদের মৃত্যুর বিষয়টি প্রচারে হাতিয়ার করেছেন তেজস্বী।
মদ বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ বিহারের মজদুর শ্রেণির মানুষও। পটনায় রিকশা চালান উমেশ কুমার। আগে দিনের শেষে রিকশা জমা দিয়ে মদ খেয়ে শুয়ে পড়তেন। মদ বন্ধ হওয়ার পরে গাঁজা-ভাংয়ের মতো শুকনো নেশার দিকে ঝুঁকেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, বিহারে মদ বন্ধ হওয়ার পরে ঘরোয়া হিংসা কমেছে ঠিকই। অন্য দিকে বেড়েছে গাঁজা, ভাং বা কাফ সিরাপ খেয়ে নেশা করার হার।
নার্কোটিক্স কন্ট্রোল বুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে যেখানে রাজ্যে ১৪ কিলোগ্রাম গাঁজা ধরা পড়েছিল সেখানে ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৮৮৭ কিলোগ্রাম। ২০১৫ সালে রাজ্যে কোনও হাশিশ ধরা না পড়লেও ২০১৭ সালে ২৪৩ কিলোগ্রাম ধরা পড়ে। একই ভাবে ২০১৫ সালে যেখানে রাজ্যে ২ কিলোগ্রাম আফিম ধরা পড়েছিল, তা-ই ২০১৭ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২৮ কিলোগ্রামে। আরজেডি নেতা অলোক রাজের কথায়, নেশামুক্তির পুনর্বাসন কেন্দ্রে যারা যাচ্ছে তাদের অধিকাংশের বয়স ১৬ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। নেশাগ্রস্তদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে মদ বন্ধ করে আদৌ লাভ হল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy