কাশ্মীর নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দিল্লিতে বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স।
৫ অগস্ট, ২০১৯। সকাল ১১টা। আমাদের অধীর আগ্রহ ও উৎকণ্ঠার অবসান সংসদ ঘটাবে বলে আশা ও আশঙ্কা ছিল। কারণ, বেশ কিছু দিন ধরে দেশের বিভিন্ন অংশে গণপিটুনি জাতীয় এমন সব ঘটনা ঘটছিল তাতে আমাদের আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। তার সঙ্গে কাশ্মীরে ক্রমশ বেশি বেশি করে আধা সামরিক বাহিনী পাঠানোর খবরও আমাদের কাছে আসছিল। সব মিলিয়ে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল। হঠাৎ করে ২ অগস্ট ঘোষণা হল, অমরনাথ যাত্রা বাতিল, কাশ্মীর থেকে সব পর্যটক বা অ-কাশ্মীরিদের চলে যেতে হবে, এমনকি, সেই সব ছাত্রছাত্রীদেরও যাঁরা ওখানকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন।
এর মধ্যে ফারুক আবদুল্লা গেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করতে। পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি আর ওমর আবদুল্লা গেলেন রাজ্যপালের কাছে, কিন্তু এঁরা কেউই কিছু জানতে পারলেন না কী ঘটতে চলেছে। রবিবার সন্ধ্যায় টেলিভিশনের খবরে দেখলাম, কাশ্মীরের সব রাজনৈতিক নেতা গৃহবন্দি আর শ্রীনগর সমেত অন্যান্য শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। কী হতে চলেছে তা শেষমেশ জানতে পারলাম যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যসভায় একসঙ্গে চারটি বিল পেশ করার সম্মতি চাইলেন চেয়ারম্যান বেঙ্কাইয়া নাইডুর কাছে।
সাধারণ ভাবে কোন বিল পেশ করা হবে সেটা জানানো হয় কর্মসূচি বিষয়ক পরামর্শদাতা কমিটির কাছে। সেই অনুযায়ী রাজ্যসভায় আলোচনার সময় স্থির হলে তার ২৪ ঘণ্টা আগে বিলের খসড়া কপি সদস্যদের কাছে পেশ করা হয়। শুধুমাত্র চেয়ারম্যানের অধিকার আছে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে না গিয়ে সরাসরি রাজ্যসভায় বিল পেশ করার অধিকার দেওয়ার। এ ক্ষেত্রে শুধু একটি নয়, চার-চারটি বিলের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের বিশেষ অধিকার প্রয়োগ করে বিল পেশ করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ঘড়িতে তখন ১১টা বেজে ২০ মিনিট, সদস্যরা বিলগুলির কপি তখনও পাননি, কিন্তু সংশোধনী পেশ করার জন্য সময় স্থির করে দিলেন চেয়ারম্যান— দুপুর সাড়ে ১২টা।
৩৭০ ধারা সম্পর্কে এই তথ্যগুলি জানেন?
ওই সময়েই জানতে পারলাম যে, রাষ্ট্রপতি বিলগুলিতে তাঁর সম্মতি জানিয়েছেন এবং গেজেটেও তা প্রকাশিত হয়ে গেছে। এই সরকার যে কত দ্রুততার সঙ্গে সংসদীয় কাজকর্ম চালাতে পারে তার অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকল এই ঘটনা।
আসলে, আমরা কি সত্যিই চাই, সামাজিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক ভাবে কাশ্মীর অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাক? এই ভাবে কি সেটা হওয়া সম্ভব? আসুন, ইতিহাসের পাতা একটু উল্টে দেখি। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট ভারতের বিভিন্ন অংশ কিন্তু এক সমসত্ত্ব ইউনিট হিসাবে বর্তমান ভারত রাষ্ট্র গঠন করেনি। সরাসরি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারত সে দিন স্বাধীন হয়েছিল। ‘প্রিন্সলি স্টেট’, অর্থাৎ, বিভিন্ন রাজন্য শাসিত অংশগুলি, যেমন, কোচবিহার, ত্রিপুরা বা হায়দরাবাদ পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে ভারত রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত হয়। পর্তুগাল শাসিত গোয়া-দমন-দিউ বা ফরাসি শাসিত চন্দননগর-পুদুচেরি— এরাও ভারতের অঙ্গীভূত হয় অনেক পরে। সব শেষে ভারতে যোগ দেয় সিকিম। স্বাধীন ভারতেও সব অঞ্চল একই নিয়মকানুনের অন্তর্ভুক্ত নয়। পূর্ণ রাজ্য যেমন আছে, তেমনই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলও আছে, আবার নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশের জন্য অন্য রকম অনেক নিয়ম আছে। লক্ষদ্বীপের শাসনব্যবস্থাও অন্য রকম। ভারতের ঐতিহ্যে যে বহুমুখীনতা আমাদের বৈশিষ্ট, আমাদের সংবিধান তাকে রক্ষা করার উপযুক্ত পরিবেশ স্বাধীন ভারতে তৈরি করে দিয়েছে।
এক রাষ্ট্র হলেই যে সারা দেশে এক আইন হতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। যে ব্রিটিশ সংসদীয় গণতন্ত্রের ধাঁচ আমরা গ্রহণ করেছি, সেই গ্রেট ব্রিটেন বা ইউনাইটেড কিংডম-এ ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস আর উত্তর আয়ার্ল্যান্ডে আইনের বিভিন্নতা লক্ষণীয়। এদের আর এক ইউনিট জিব্রাল্টার আবার এ সব আইনেরও বাইরে। আসলে, সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা যেখানে থাকে সেখানে আইনেরও বিভিন্নতা থাকা বাঞ্ছনীয়। এই সত্যটা আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ৩৭০ বাতিল, বিশেষ অধিকারের সঙ্গে রাজ্যের মর্যাদাও হারাচ্ছে জম্মু-কাশ্মীর, ভেঙে আলাদা হচ্ছে লাদাখ
ভারত রাষ্ট্রে যোগদানের ব্যাপারে জম্মু-কাশ্মীরের তৎকালীন রাজা হরি সিংহ যথেষ্টই দোলাচলে ছিলেন। স্বাধীন থাকলে বেশি সুবিধা পাবেন কি না, হিন্দুরাজা এই হিসেব করতে যখন ব্যস্ত তখন তাঁর মুসলমান প্রজা শেখ আবদুল্লা তাঁর সংগঠনের নাম পাল্টে ন্যাশনাল কনফারেন্স করে ভারতে যোগদানের জন্য আন্দোলন করছিলেন সেই ১৯৪৭ সালে। পাকিস্তান যখন আদিবাসীদের ছদ্মবেশে কাশ্মীর আক্রমণ করছে তখন ওই ন্যাশনাল কনফারেন্স রাজাকে প্রায় বাধ্য করেছিল ভারতের সঙ্গে সংযুক্তিকরণ চুক্তি সই করতে। ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে এই ন্যাশনাল কনফারেন্সের সদস্যরা যে অংশ থেকে পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়, আজ কাশ্মীরের সেই অংশই ভারতের সঙ্গে যুক্ত। এর পর ঝিলম নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। সংযুক্তিকরণ চুক্তিতে রাজা হরি সিংহ ভবিষ্যৎ দরকষাকষির সুযোগ রাখতে পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সংযুক্তিকরণ চূড়ান্ত করার শর্ত জুড়ে দেন। কাশ্মীরে তখন লড়াইটা এই নিয়ে যে, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে যোগ দেওয়া হবে না ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানে যাওয়া হবে। আশ্চর্যের বিষয়, অধিকাংশ সদস্য মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ন্যাশনাল কনফারেন্স ভারতে যোগদানে দৃঢ়সঙ্কল্প ছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মীরকে বিশেষ কিছু অধিকার দিয়ে সংবিধানে ৩৭০ ধারা সংযোজিত হয়। কাশ্মীরবাসীকে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে ভারত রাষ্ট্র যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে কাশ্মীরের বৈশিষ্ট ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করবে। আজ কাশ্মীরে নির্বাচিত বিধানসভা নেই, প্রধান বিরোধী নেতারা গৃহবন্দি, যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত, উপত্যকা জুড়ে আধা সামরিক বাহিনী, পর্যটক ও তীর্থযাত্রীরা কার্যত বহিষ্কৃত। এই প্রেক্ষিতে প্রায় কোনও আলোচনা না করেই ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করা আদৌ গণতন্ত্রসম্মত না বহুত্ববাদী পুরুষতন্ত্রের দিকে এক সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ?
(লেখক অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy