১৯৮৪ থেকে বিজেপির উত্থান। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে কি তার একটু বেশিই হবে। যতদূর মনে পড়ছে ১৯৬৮ সাল। তখনও মানুষ রাজনীতির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়নি। বাংলার বুকে খুব সন্তর্পণে চরমপন্থী রাজনীতি মাথা তুলছে। বামপন্থীদের রমরমা আর কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলধন তখন অভিমান আর দাম্ভিক উচ্চারণের জায়গা নিয়েছে। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ মধ্যবিত্তের হাতে। সব দলের নেতৃত্বে লেখাপড়া জানা মধ্যবিত্ত মানুষ। কেউ বামপন্থাকে আশ্রয় করেছেন— সমাজ পাল্টে গিয়ে নতুন সমাজ আসবে, মানুষ ভাল ভাবে থাকবে-পরবে-খাবে। আবার অন্যদিকে, অহিংস গাঁধীবাদের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে সুভাষচন্দ্রের অজ্ঞাতবাস থেকে ফিরে আসার গল্প— সুভাষ আসছেন।
এই প্রেক্ষাপট আলোচনার শুরুতে করে রাখতে হল। কারণ, বাঙালি তখনও রাম বা রামমন্দির নিয়ে ভাবেনি। ভাবতে চায়নি। এটা বলে রাখা ভাল। কারণ, মধ্যবিত্ত বাঙালির চায়ের টেবিলে কখনওই ‘রাম ভগবান না মানুষ’— এ রকম কোনও অ্যাজেন্ডা আলোচিত হয়নি।
সেই কারণেই ঘটনাটা ঘটেছিল। যদিও তার প্রতিক্রিয়া রামভক্তদের কাছ থেকে আসছিল। বেশ কড়াগোছের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু সাধারণ মানুষ অথবা রাজনৈতিক নেতারা কেউ এ বিষয়ে মাথা দেননি। প্রয়োজনও বোধ করেননি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন ভাষাবিদ হিসেবে। রাজনীতিও তাঁর কাছে অপাংক্তেয় ছিল না। স্বাধীনতার পরে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। উল্লেখযোগ্য সময়। সে ভাবেই পালন করেছেন তাঁর ভূমিকা।
গুজরাতের সোমনাথ থেকে অযোধ্যা যাত্রা লালকৃষ্ণ আডবাণীর। ১৯৯০ সালে।
আরও পড়ুন: এত দিনে বাবরি ধ্বংসের রায়! অক্ষমের উল্লাস ছাড়া আর কী?
ফলে ১৯৬৮ সালে তিনি যখন তথ্য আর প্রমাণ দিয়ে দেখালেন যে রামায়ণ কোনও হিন্দু ধর্মগ্রন্থ নয়, প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করলেন পালি ভাষায় লেখা দশরথ-জাতকের, আর দেখালেন যে রামায়ণ বা রাম চরিত্র শুধু বাল্মীকি লেখেননি। রামায়ণ তৈরি হয়েছে বহু কবি আর ঋষিদের সম্মিলনে। হিন্দু মৌলবাদীদের কাছে এই তথ্য শুধু বিড়ম্বনা নয়, বিশ্বাসভঙ্গ। রামভক্তদের কাছে ষড়যন্ত্র।
চিঠি আসতে শুরু করল। অধিকাংশই বেনামী চিঠি। বিভিন্ন ধরনের হুমকি। কোনওটিতে গালিগালাজ, কোনওটিতে প্রাণনাশের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হল।
এ কথা সুনীতিকুমারকে ব্যস্ত করেননি। বাঙালিও ব্যস্ত হয়নি। পণ্ডিতমহল আলোচনার বিষয় পেয়েছিল, এ তথ্যে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু এখন এ ঘটনা ঘটলে গণ্ডগোল অনেক দূর পর্যন্ত গড়াতো। সেখানে তথ্যপ্রমাণের লড়াই হত না। পরিষ্কার গালিগালাজ আর আক্রমণ চলত। সুনীতিকুমারের বাড়িতে পাঞ্জাবির দোকানের জায়গায় পাঁচ ‘সমাজ সংস্কারক’ পৌঁছে যেতেন। সেই সঙ্গে লোকলস্কর নিয়ে…।
যাক সে কথা। রামের সম্পর্কে দু’এক কথা জানার চেষ্টা করি।
মনিয়র উইলিয়ামস ‘রাম’ শব্দের অর্থ বলেছেন কালো, কৃষ্ণবর্ণ আর ‘রাত্রি’র সঙ্গে শব্দের যোগসূত্র লক্ষ্য করেছেন। বেদে কিন্তু বিপরীত অর্থে ব্যক্ত হয়েছে— ‘রাম’ মানে সুন্দর, আনন্দদায়ক, রমণীয়— এ কথা জেনেছি বিমলকৃষ্ণ মতিলালের কাছে। তখন ‘রাম নরচন্দ্রমা কৃষ্ণ পুরুষোত্তম’ বইটি লিখছেন আর প্রকাশকের তাড়া খেয়ে মাঝেমধ্যে নিজের ঘর আর অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রকাশনা বিভাগে চলে আসছেন। সেই সময়ের ছাত্র হিসেবে এই কথা জানা গেল। কিন্তু এটাও সত্যি যে,রামকে মর্যাদা পুরুষোত্তম বা ধর্মের শ্রেষ্ঠ রক্ষকের সম্মান দেওয়া হয়। সে আলোচনা বাদ দিলেও শুধুমাত্র রাম নিয়ে দেশবিদেশে আলোচনার শেষ নেই। রাম হচ্ছেন সেই ভগবান, যাঁর মৃত্যু হয়। এটা গুরুত্বপূর্ণ কথা। ফলে রাম ধর্মের শ্রেষ্ঠ রক্ষক কি না বা সীতার প্রতি তাঁর আচরণ বিভিন্ন শাস্ত্রে বিভিন্ন ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। যে রামায়ণ অনুযায়ী তিনি সীতাকে বনবাসে পাঠান এবং দুই সন্তানের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হন।
১৯৯১ সালে দিল্লিতে অটল বিহারী বাজপেয়ীর জনসভা।
তাঁর সঙ্গে মর্যাদা পুরুষোত্তম বা নরচন্দ্রমা রামের তফাৎ খুঁজে পাই। এ বার প্রশ্ন হল রামের জন্ম কবে? নবরাত্রির দিন। নবরাত্রি অর্থে চৈত্র মাসের ৯ তারিখ। ইংরেজি হিসেবে মার্চ অথবা এপ্রিল মাসে। সারা দেশ জুড়ে এমনকি, বিদেশেও যা পালিত হয়। পবিত্র সরযূ নদীতে স্নান করে অযোধ্যার রামমন্দিরে পুজো দেওয়া পুরনো রীতি। উপোস করে ব্রত পালন করাই নিয়ম।
বালি (ইন্দোনেশিয়া), ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার), কম্বোডিয়া, তাইল্যান্ড বা নেপালে ভারতের মতোই বড় করে পালন করা হয় রামলীলা। অর্থাৎ রাবণবধের আয়োজন। তেমনই দীপাবলিতে পালিত হয় অযোধ্যায় রামের ফিরে আসার দিন। বৌদ্ধ, শিখ এবং জৈনরাও রামকে তাঁদের ধর্মশাস্ত্রে গ্রহণ করেছেন।
কিন্তু রাম প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে ‘এলেন’ ১৯৮৯ সালে। হিমাচলপ্রদেশের পালমপুর কনভেনশনে বিজেপি সরাসরি প্রস্তাব আনল অযোধ্যায় রামমন্দির স্থাপনের। সে প্রস্তাব গৃহীত হল। প্রস্তাব এল নির্বাচনী ইস্তাহারে— ৫০০ বছরের বিতর্কিত জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের কথা বলে।
খেয়াল রাখতে হবে, ১৯৮৪ সালের লোকসভা ভোটে সারা দেশে বিজেপি মাত্র ২টি আসন পেয়েছিল। আর ১৯৮৯ সালে আনা হল রামমন্দির প্রস্তাব। এখন ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আর রামমন্দির প্রশ্নে অনড়। বিজেপি তার সংকল্পপত্রে ১৯৯৬ থেকে ধারাবাহিক ভাবে ২০১৯-এর লোকসভা ভোট পর্যন্ত বলেছে, তারা রামমন্দির বানাবে। শ্রীরামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্রে ট্রাস্ট সময় নিয়েছে সাড়ে ৩ বছর। এখন কোভিড পরিস্থিতিতে সময় কিছুটা বাড়বে বলেই ধারণা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই উদ্যোগের সূচনা করে এসেছেন অগস্ট মাসে।
১৯৯৬ থেকে ২০১৯-এর লোকসভা ভোট পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে
রাম মন্দিরের বিষয়টি তাদের সংকল্পপত্রে রেখেছে বিজেপি।
আরও পড়ুন: শেষ গম্বুজটাও ভেঙে পড়তে দেখলাম ৪টে ৪৯ মিনিটে
বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামের জন্ম অযোধ্যায়। কিছু মানুষের কথায়, বাবরি মসজিদ যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই রামচন্দ্র জন্মেছিলেন। সেখানে রামের মন্দির ধ্বংস করে বাবর মসজিদ বানিয়েছিলেন। সেই ‘বাবর-ই-মসজিদ’। বিরোধীরা বলছেন, এ গল্প ১৮ শতকের। তার আগে রাম জন্মভূমির কোনও ‘প্রমাণ’ কেউ দেখাননি।
মির বাকি ছিলেন বাবরের সেনাপতি। তিনি নাকি মন্দির ভেঙে মসজিদটি তৈরি করেন ১৫২৮-’২৯ সালে। ভারতের পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ মসজিদের নীচে একটি মন্দিরের অংশ খুঁজে পায়। ১৮৫৯ সালে ইংরেজ সরকার একটি পাঁচিল দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের জন্য আলাদা আলাদা জায়গা ঠিক করে দেন। হিন্দুরা পাঁচিলের বাইরে পুজো দেবে, আর মুসলমানেরা ব্যবহার করবে পাঁচিলের ভিতরে মসজিদের অংশ।
মহন্ত রঘুবীর দাস প্রথম মামলা করেন ফৈজাবাদ জেলা আদালতে। মসজিদের বাইরে রামচবুতরার উপরে একটি চন্দ্রাতপ বা ছাউনি তৈরির জন্য আদালতের সম্মতি চান তিনি। ফৈজাবাদ আদালত কিন্তু সম্মতি দেয়নি। আবেদন বাতিল করেছে। সেটা ১৮৮৫ সাল।
ভূমিপূজন উপলক্ষে অযোধ্যায় রামভক্তেরা।
প্রায় ৬৫ বছর পরে আরেকটি ঘটনা ঘটল। ১৯৪৯ সাল, গোরক্ষনাথ মঠ থেকে ৯ দিন একটানা রামচরিত মানস পাঠ চলল। পাঠশেষে ২২ ডিসেম্বর অখিল ভারতীয় রামায়ণ মহাসভার তরফে হিন্দু সন্তদের নেতৃত্বে মসজিদের দরজা ভেঙে ভিতরে রাম-সীতার মূর্তি বসিয়ে দেওয়া হল। গোটা ঘটনাটি ঘটে দ্বিগ্বিজয় নাথের নামে।
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছিলেন মূর্তি সরিয়ে দিতে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন জানায়, সেটা করতে গেলে সাম্প্রদায়িক গন্ডগোল শুরু হয়ে যাবে। বরং তারা মসজিদ তালা মেরে বন্ধ করে দিচ্ছেন, যাতে ভিতরে কেউই না ঢুকতে পারে। পুজোআচ্চার ব্যবস্থা করতে না পারে।সেই বন্দোবস্ত মেনে নেওয়া হয়। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড আর অখিল ভারতীয় রামায়ণী মহাসভা পরস্পরের বিরুদ্ধে আদালতে যায়। আর পুরো বিষয়টি বিচারবিভাগের আওতায় চলে যায়।
এরপর ১৯৮৯ সাল। বিজেপি তাদের সম্মেলনে প্রস্তাব গ্রহণ করে রামমন্দির নিয়ে। আর ১৯৯০ সালে আডবাণী গুজরাতের সোমনাথ মন্দির থেকে শুরু করেন তাঁর রথযাত্রা।
বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক হিংসা শুরু হয়। আডবাণী গ্রেফতার হন বিহারে।
তারপর এল ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। সেদিন সারা পৃথিবী দেখেছিল হাতুড়ি-শাবল-গাঁইতি দিয়ে বাবরি ভাঙার দৃশ্য। দাঙ্গায় সারা দেশে মারা যান প্রায় ২,০০০ মানুষ।
লিবারহান কমিশন বসেছিল সে বছর ১৬ ডিসেম্বর। রিপোর্টে বিচারপতি লিবারহান অভিযোগের আঙুল তোলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী-লালকৃষ্ণ আডবাণী-মুরলি মনোহর জোশী-উমা ভারতী-সহ একাধিক বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের নেতার দিকে।
রামমন্দিরের ভূমিপূজনে নরেন্দ্র মোদী।
পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় যে দল যখন এসেছে, তারাই কমবেশি এই মন্দির-মসজিদ বিতর্কে পড়েছেন। কারণ—রাজনীতি।
গত ৫ অগস্ট প্রধানমন্ত্রী অযোধ্যায় শিলান্যাস আর ভূমিপূজন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য আর ইতিহাসচেতনা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু রাজনীতিই শেষ কথা।রাম নয়।
সীতা আর রাম ভাই-বোন কি না, সে প্রশ্নও আর আলোচিত হবে না।যেমন শম্বুককে কী কারণে রাজা রামচন্দ্র হত্যা করেছিলেন, সেটাও এখন আর আলোচনার বিষয় নয়। কারণ, মহাকাব্যের আলোচনাই এখন বিষয় হবে না। হবে রাজনীতি আর অন্ধ ভক্তিবাদ। কোনও প্রশ্ন নয়, সাবধান!
(লেখক গবেষক এবং রাজনীতিবিদ। মতামতের জন্য আনন্দবাজার ডিজিটাল দায়ী নয়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy