Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Ayodhya Case

জমি রামের নামে, নিয়ন্ত্রিত উচ্ছ্বাসে বিজেপি-সঙ্ঘ, স্বাগত জানাল কংগ্রেসও, অসন্তুষ্ট সুন্নি বোর্ড

শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের দাবি এ দিন প্রথমেই খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ।

রায় ঘোষণার পর উচ্ছ্বাস অযোধ্যার হিন্দুদের মধ্যে। ছবি: এপি।

রায় ঘোষণার পর উচ্ছ্বাস অযোধ্যার হিন্দুদের মধ্যে। ছবি: এপি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৯ ২০:৫৮
Share: Save:

‘মিল কা পত্থর’, অর্থাৎ মাইলফলক। রায় ঘোষিত হওয়ার অল্প ক্ষণের মধ্যেই টুইটারে লিখলেন দেশের শাসক দলের সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অমিত শাহ যে মহানন্দেই টুইটটা করলেন, তা নিয়ে সন্দেহ কমই। কিন্তু যাঁরা একেবারেই আনন্দিত হতে পারেননি, তাঁরাও জানেন এই রায় ‘মাইলফলক’-ই।

মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড স্পষ্ট জানিয়েছে, এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট নয়। তবু বোর্ডের কৌঁসুলি বলেছেন, ‘রায়কে সম্মান করি’। বিজেপি এবং আরএসএস নেতৃত্ব প্রত্যাশিত ভাবেই চোখেমুখে প্রশান্তি নিয়ে রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু কিছুটা বিস্ময় জাগিয়েই কংগ্রেসের বয়ানেও বিন্দুমাত্র বেসুর নেই। রণদীপ সুরজেওয়ালার কণ্ঠে প্রায় বিজেপির বয়ানেরই প্রতিধ্বনি। এমআইএম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি ছাড়া কোনও রাজনৈতিক নেতাকে অযোধ্যা মামলার এই রায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে দেখা গেল না শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত।

শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের দাবি এ দিন প্রথমেই খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ। অযোধ্যার বিতর্কিত জমির উপরে শিয়া বোর্ডের কোনও দাবি থাকতে পারে না বলে জানানো হয়। মামলার আর এক পক্ষ নির্মোহী আখড়ার দাবিও যুক্তিযুক্ত নয় বলে আদালত জানিয়ে দেয়। তার পরে জানিয়ে দেওয়া হয়, জমি ভাগাভাগি হচ্ছে না। বিতর্কিত জমির পুরোটাই রামলালা বিরাজমানকে দেওয়া হচ্ছে। আর মসজিদ তৈরি করার জন্য অযোধ্যাতেই অন্য কোথাও ৫ একর জমি দেওয়া হচ্ছে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে।

খবরে চোখ আটকে খুদেদেরও। ছবি: পিটিআই।

অযোধ্যায় মন্দির-মসজিদ বিতর্ক

কেন এই রায়? কিসের ভিত্তিতে বিতর্কিত জমির উপরে রামলালা বিরাজমানের অধিকার স্বীকার করে নিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত? ১০৪৫ পাতার রায়ে বিচারপতিদের যে সব পর্যবেক্ষণ সামনে এসেছে, তা থেকে কিন্তু মনে হচ্ছে না যে, সব যুক্তি ঝুঁকে রয়েছে কোনও একটি পক্ষের দিকে। সর্বোচ্চ আদালত কোথাও বলেছে, বাবরি মসজিদ কোনও ফাঁকা জমিতে তৈরি হয়নি, তার নীচে আরও প্রাচীন অমুসলিম স্থাপত্যের সন্ধান পেয়েছে পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ। আবার তার পরেই বলেছে, মসজিদের নীচে যে স্থাপত্য মিলেছে, তা হিন্দু স্থাপত্যও যদি হত, তা হলেও ওই জমি হিন্দুদের হয়ে যায় না।

তা হলে বিতর্কিত জমি কার? বিচারপতিরা রায়ে লিখেছেন, ১৮৫৭ সালের আগেও যে রামজন্মভূমিতে হিন্দু পুন্যার্থীদের যাতায়াত ছিল। বিতর্কিত অংশের বাইরের চত্বরেও যে হিন্দুরাই পূজার্চনা করতেন, তা-ও স্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত বলে আদালত মনে করেছে। কিন্তু ১৮৫৭ আগে ওই অংশ সম্পূর্ণ ভাবে মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, এমন কোনও প্রমা‌ণ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড দাখিল করতে পারেনি বলে আদালত মনে করছে।

ওয়াকফ বোর্ড শুধুমাত্র ওই প্রমাণটা দাখিল করতে পারল না বলেই কি জমির দখল রামলালা পেলেন? না, তেমন কোনও কথাও রায়ে লেখা নেই। বিতর্কিত জমির উপরে রামলালা বিরাজমানের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেপথ্যে বরং অন্য দু’টি কারণ সামনে আসছে। প্রথমত, বিতর্কিত জমিকে যে হিন্দুরা রামের জন্মস্থান হিসেবে বিশ্বাস করেন, তা নিয়ে কোনও বিতর্ক বা বিরোধ নেই বলে আদালত মনে করেছে। আর দ্বিতীয়ত, বিতর্কিত জমিতে রামলালার অধিকার স্বীকার করে নেওয়াটা আইন-শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বহাল রাখার প্রশ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে বিচারপতিরা মনে করেছেন।

রায় ঘোষণার পর ভিএইচপি সমর্থকরা। ছবি: পিটিআই।

আরও পড়ুন: মসজিদ ধ্বংস বেআইনি ছিল, তবু জমি পেলেন রামলালা: কোন যুক্তিতে জেনে নিন​

কেন্দ্রীয় সরকারকে আদালত নির্দেশ দিয়েছে, তিন মাসের মধ্যে একটি ট্রাস্ট গঠন করে তার হাতে মন্দির নির্মাণের দায়িত্ব তুলে দিতে। অযোধ্যাতেই অন্য কোথাও ৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে তা সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশও সরকারকে দিয়েছে আদালত। মন্দির নির্মাণের পাশাপাশিই যাতে মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়ে যায়, সে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

রায় যখন ঘোষণা হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে, করতারপুর করিডরের সূচনা অনুষ্ঠানে। সুতরাং প্রথম প্রতিক্রিয়া টুইটারে জানান প্রধানমন্ত্রী। রামভক্ত হন বা রহিম ভক্ত, এখন ভারতভক্তির সময়— বার্তা দেন তিনি। আর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই দিনটি একটি স্বর্ণিল অধ্যায়’। ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তির প্রশংসা শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখে। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে গোটা দেশ খোলা মনে মেনে নিয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন। সুপ্রিম কোর্ট আজ রাম মন্দির নির্মাণের পক্ষে যে রায় দিয়েছে, তাতে যে তিনি সন্তুষ্ট, সে ইঙ্গিতও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে মিলেছে।

কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গাঁধীও কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দির নির্মাণ বা বিকল্প জমিতে মসজিদ তৈরির প্রসঙ্গ নিজের টুইটে উল্লেখ করেননি রাহুল। শুধু আদালতের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানোর এবং নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

আদালতের রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। ছবি: পিটিআই।

আরও পড়ুন: অযোধ্যা রায়ে খুশি নয়, তবে পাল্টা আবেদন করবে না সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড​

কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালার বয়ান অবশ্য রাহুলের বয়ানের চেয়ে কিছুটা বেশি খোলামেলা। তিনিও আদালতের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানোর কথা বলেছেন। রাম মন্দির তৈরির নির্দেশ প্রসঙ্গে সন্তোষ প্রকাশও করেছেন।

যে উত্তরপ্রদেশে মন্দির তৈরি হতে চলেছে আদালতের নির্দেশে, সেই উত্তরপ্রদেশের অন্য দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি সমাজবাদী পার্টি বা বহুজন সমাজ পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বের তরফ থেকে কিন্তু কোনও বয়ান এ দিন মেলেনি। বামেরা সব দিক বাঁচিয়ে বয়ান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এনডিএ-র একাধিক দল স্বাভাবিক কারণেই সন্তোষ প্রকাশ করেছে। কিন্তু অন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলির অধিকাংশই কোনও মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে শনিবার।

প্রত্যাশিত ভাবেই উচ্ছ্বসিত সঙ্ঘ পরিবার। এ দিন দুপুরে সাংবাদিক সম্মেলন করে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানান আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। এই রায়কে কারও হার বা কারও জয় হিসেবে দেখা উচিত নয়— বলেন সরসঙ্ঘচালক। সরকার কোথায় এবং কী ভাবে ৫ একর জমি সুন্নি বোর্ডকে দেবে, তা নিয়ে যে তিনি মাথা ঘামাতে রাজি নন, সে বার্তা নিজের সাংবাদিক সম্মেলনে বেশ স্পষ্ট ভাবেই দেন তিনি। শুধুমাত্র রাম মন্দির তৈরি নিয়েই যে সঙ্ঘ ভাবছে, অন্য কিছু নিয়ে নয়, সে কথাও কোনও রাখঢাক না করেই বলেন।

সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড এই রায়ে খুশি নয়। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডও অসন্তুষ্ট। ওয়াকফ বোর্ডের কৌঁসুলি জাফরিয়াব জিলানি এ দিন বলেন, ‘‘রায়কে আমরা সম্মান জানাচ্ছি। কিন্তু এই রায়ে খুশি নই।’’ পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, এই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করা হবে কি না, তা আলোচনা করে স্থির করা হবে বলে তিনি জানান। আর মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের তরফে বলা হয়, এ ভাবে মসজিদ কাউকে হস্তান্তর করা যায় না।

রায়ে সব পক্ষ খুশি নয়, তা স্পষ্ট। তবে এই রায় ঘোষিত হওয়ার পরে কোনও অশান্তি কিন্তু দেশের কোনও প্রান্তেই এ দিন হয়নি। কেউ সন্তোষ প্রকাশ করেছে, কেউ রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন, কেউ সম্পূর্ণ নীরব থেকেছেন। অসন্তোষও হয়তো প্রকাশ্যে এসেছে কোনও কোনও মহল থেকে। কিন্তু ১৩৪ বছর ধরে চলতে থাকা আইনি লড়াইয়ে যে দিন ইতি টানতে চেয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত, সে দিন অন্তত কোনও পক্ষই দায়িত্বজ্ঞানের সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy