২০১৭-র বিধানসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশের ৪০৩টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৩২৫টি আসন পেয়েছিল বিজেপি জোট (বিজেপি একাই ৩১২)। জোট গড়ে লড়ে সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ৪৭ এবং কংগ্রেস ৭টিতে জিতেছিল। মায়াবতীর বিএসপি জিতেছিল ১৯টিতে। ত্রিমুখী লড়াইয়ে সহযোগীদের নিয়ে ৪০ শতাংশের ভোট গিয়েছিল পদ্মশিবিরে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভোটে কে জিতবে? ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে ভোটপর্ব শেষ হওয়ার পরে একটি বুথফেরত সমীক্ষায় বড় অংশের ভোটদাতার উত্তর ছিল— নরেন্দ্র মোদী! তাঁর ভাবমূর্তি এবং উন্নয়নের মোড়কে জাঠ, অ-যাদব অনগ্রসর, অ-জাটভ দলিত শ্রেণির সঙ্গে ব্রাহ্মণ-ঠাকুর-বানিয়া উচ্চবর্ণের মিশেলে বিজেপি এমন এক দাওয়াই হাজির করেছিল, যাতে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টির এম-ওয়াই (মুসলিম-যাদব) সমীকরণ।
পাঁচ বছরে গঙ্গা-যমুনা-গোমতী-সরযূ নদী দিয়ে জল বয়ে গিয়েছে অনেক। এ বারের বিধানসভা ভোটে পদ্মশিবিরের প্রচারে মোদীর পাশাপাশি সমান ভাবে উঠে এসেছে গত পাঁচ বছরের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নাম। টানা দ্বিতীয় বার লখনউয়ের কুর্সি দখল করতে পারলে ভবিষ্যতে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে অমিত শাহের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন বলে মনে করছে দলেরই একটি অংশ। বস্তুত, যোগীর ‘আশি-বিশের ভোট’-এর স্লোগান (যা উত্তরপ্রদেশে হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতের ইঙ্গিতবাহী) আর ‘মাফিয়া’ দমনের কৃতিত্বই এ বার বিজেপি-র প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার। তার সঙ্গেই রয়েছে বিনেপয়সার আনাজ এবং হিজাব বিতর্কে যোগী সরকারের ভূমিকা। যা দেখে অনেকে বলতে শুরু করেছেন, হিন্দু মহিলাদের সঙ্গে মুসলিম মহিলা ভোটের একাংশও নাকি যেতে পারে যোগীর বাক্সে।
বুথফেরত সমীক্ষায় প্রায় সমস্ত সংস্থাই উত্তরপ্রদেশে যোগীকে এগিয়ে রেখেছে। যদিও একেকটি সংস্থার বিচারে প্রাপ্ত আসনের সংখ্যা একেক রকমের। যদিও বুথফেরত সমীক্ষার ফলাফল সবসময় আসল ফলের সঙ্গে মেলে না। অতীতেও এমন অনেক সমীক্ষার ফল আসল ফলের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুরো উল্টেও গিয়েছে। সাম্প্রতিক কালে বিহার বিধানসভার ভোট তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
তথ্য বলছে, ২০১৭-র বিধানসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশের ৪০৩টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৩২৫টি আসন পেয়েছিল বিজেপি জোট (বিজেপি একাই ৩১২)। জোট গড়ে লড়ে সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ৪৭ এবং কংগ্রেস ৭টিতে জিতেছিল। মায়াবতীর বিএসপি জিতেছিল ১৯টিতে। ত্রিমুখী লড়াইয়ে সহযোগীদের নিয়ে ৪০ শতাংশের ভোট গিয়েছিল পদ্মশিবিরে।
অঞ্চল ভিত্তিক ভোটের বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছিল পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, রোহিলাখণ্ড, অওয়ধ (অযোধ্যা), বুন্দেলখণ্ড, পূর্বাঞ্চলের মতো সব অঞ্চলেই প্রতিপক্ষকে টেক্কা দিয়েছিল বিজেপি। বিজেপি-র এমন সাফল্যের পিছনে ২০১৩-র মুজফ্ফরনগর গোষ্ঠীহিংসা পরবর্তী ভোটের মেরুকরণের বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। ২০১৪ সালের লোকসভাতেও ওই মেরুকরণের সুফল পেয়েছিল মোদীর দল।
এ বার পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের যে ৫৮টি আসনে প্রথম দফায় ভোট হয়েছে, ২০১৭-য় তার ৫৩টিতেই পদ্ম ফুটেছিল। বিএসপি এবং এসপি ২টি করে আসন জিতেছিল। অবশিষ্ট আসনটি গিয়েছিল আরএলডি-র ঝুলিতে। এ বার কৃষিআইন বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ভরকেন্দ্র ছিল ওই অঞ্চল। পাশাপাশি, জাঠ-অধ্যুষিত ওই কেন্দ্রগুলিতে মেরুকরণের হাওয়াও তেমন তীব্র ছিল না। ফলে বিজেপি-র আসন কমার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
রামমন্দির নির্মাণের স্লোগানে ভর করে ২০১৭ সালে অওয়ধ অঞ্চলের ১৩৭টি আসনের মধ্যে ১১৭টিতে জিতেছিল বিজেপি। দ্বিতীয় স্থানে থাকা এসপি মাত্র ১১! ‘রামজন্মভূমি’-তে মন্দির গড়তে ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং ২০২০-তে করোনা আবহে প্রধানমন্ত্রীর ঘটা করে ভূমিপূজন, শিলান্যাসের পরে রামমন্দিরের আবেগ ভোটারদের কতটা স্পর্শ করবে, তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে।
পূর্বাঞ্চলে সক্রিয় সুহেলদেব ভারতীয় সমাজ পার্টি (এসবিএসপি), আপনা দল(কে)-এর মতো অ-যাদব অনগ্রসর গোষ্ঠী-নির্ভর রাজনৈতিক শক্তিগুলি এ বার এসপি-র সঙ্গে হাত মেলানোর সেখানেও কিছুটা লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রসঙ্গত, মোদীর বারাণসী এবং যোগীর গোরক্ষপুর নিয়ে গঠিত এই অঞ্চলের ১৬০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২০১৭-য় বিজেপি সেঞ্চুরি করেছিল। উত্তরপ্রদেশের অন্য অঞ্চলগুলিতে অবশ্য বিজেপি এগিয়ে থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটেও উত্তরপ্রদেশের জয়ের ধারা বজায় ছিল বিজেপি-র। সে রাজ্যের ৮০টি আসনের মধ্যে ৬২টিতে জেতে তারা। জোট গড়ে লড়ে বিএসপি ১০ এবং এসপি ৫টিতে জেতে। কংগ্রেসের ঝুলিতে যায় একটি। বহুমুখী লড়াই সত্ত্বেও প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থীরা।
ভোট বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছে, উত্তরপ্রদেশে এ বারের বাকি দুই বিরোধীপক্ষ কংগ্রেস এবং বিএসপি অনেকটা ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়ায় বিজেপি-র লড়াই কঠিন হতে পারে। সংখ্যালঘু ভোট ‘একমুখী’ হয়ে সমস্যা বাড়াতে পারে পদ্মশিবিরের। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-এর ‘নীলবাড়ির লড়াই’। গত বিধানসভা ভোটে রাজ্যে সিপিএম-কংগ্রেস এমন ভাবেই ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে গিয়েছিল। আর তার জেরে বিজেপি-কে হারতে হয়।
উত্তরপ্রদেশের পাশাপাশিই বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশিত হবে উত্তরাখন্ড, পঞ্জাব, গোয়া এবং মণিপুরে। এর মধ্যে গোয়া নিয়ে বাংলার মানুষের আকর্ষণ রয়েছে। কারণ, সেখানে এই প্রথম ভোটে লড়ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল। যদিও সেখানে ভোটের মূল দায়িত্বে তৃণমূল সাংসদ তথা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
উত্তরপ্রদেশে ভেঙে ২০০০ সালে গঠিত উত্তরাখণ্ডে গত দু’দশক ধরেই বজায় রয়েছে পাঁচ বছর অন্তর পরিবর্তনের ধারা। হিমালয়ঘেরা রাজ্যের ৭০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২০১৭-য় বিজেপি ৫৭টিতে জিতেছিল। কংগ্রেসের ঝুলিতে গিয়েছিল ১১টি। অন্যান্যরা ২টিতে। এ বার সে রাজ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারে বলে কয়েকটি বুথফেরত সমীক্ষার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। যদিও ভারতের ভোট-রাজনীতির ইতিহাস বলছে, অনেক সময়ই এমন ধরনের সমীক্ষার পূর্বাভাস মেলে না। তবে ভোটের আগে যশপাল আর্য, হরক সিংহ রাওয়তের মতো প্রভাবশালী মন্ত্রীদের বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদান ‘দেবভূমি’ উত্তরাখণ্ডের সেই ‘পরিবর্তনের ঐতিহ্যের অনুসারী’ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
পঞ্জাবের বিধানসভা ভোটে এ বার স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক সমীকরণ ভেঙে যেতে পারে বলে অধিকাংশ বুথফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস। শিরোমণি অকালি দল আর কংগ্রেস রাজনীতিতে বিভক্ত পঞ্চনদের তীরে এ বার অরবিন্দ কেজরীবালের আম আদমি পার্টি (আপ) সরকার গঠনের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকবে বলে ওই সমীক্ষাগুলির দাবি।
অবশ্য এর আগে দু’বার পঞ্জাবের ভোটযুদ্ধে ‘রানার আপ’ হওয়ার উদাহরণ রয়েছে কেজরীবালের দলের। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে ওই রাজ্যের ১৩ আসনের মধ্যে অকালি-বিজেপি জোট ৬ এবং আপ ৪টিতে জিতেছিল। কংগ্রেস জিতেছিল ৩টিতে। আবার ২০১৭-র বিধানসভা ভোটে ১১৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭৭টিতে জিতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায় কংগ্রেস। আপ ২০টিতে জিতে হয় দ্বিতীয়। অকালি দল-বিজেপি জোট ১৮টি (১৫+৩)-তে জেতে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে অবশ্য আপ-এর আসন ১-এ নেমে আসে। কংগ্রেস একাই জেতে ৮টিতে।
এ বার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহের দলত্যাগ এবং মুখ্যমন্ত্রী চরণজিৎ সিংহ চন্নীর সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নভজ্যোৎ সিংহ সিধুর বিবাদের জেরে কংগ্রেস কিছুটা বিপাকে। কৃষিবিলের বিরোধিতা করে সে রাজ্যে বিজেপি-কে ছেড়ে মায়াবতীর সঙ্গে সমঝোতা করেছে অকালি দল। অন্য দিকে, নয়া দল ‘পঞ্জাব লোক কংগ্রেস’ গড়ে অমরেন্দ্র শামিল হয়েছেন পদ্মশিবিরে। গত আট বছরে দক্ষিণ পঞ্জাবের মালওয়া অঞ্চলে আপ-এর সাংগঠনিক সক্রিয়তা অনেকটাই বেড়েছে। এই অঞ্চলের ৬৯টি আসনের বড় অংশ এ বার কেজরীবালের ঝুলিতে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৭-য় গোয়া এবং মণিপুরে কংগ্রেসের চেয়ে কম আসনে জিতেও সরকার গড়েছিল বিজেপি। ক্ষমতার অপব্যবহার, বিধায়ক কেনাবেচা এমনকি সংশ্লিষ্ট দুই রাজ্যের রাজ্যপালের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ উঠেছিল সে সময়।
৪০ আসনের গোয়ায় এ বার ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হতে পারে বলে কয়েকটি জনমত সমীক্ষার ইঙ্গিত। সে ক্ষেত্রে নির্ণায়ক হতে পারে তৃণমূল-মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টি (এনজিপি) জোটের ভূমিকা। ২০১৭-য় গোয়ায় কংগ্রেস ১৭ এবং বিজেপি ১৩টি আসনে জেতে। আলাদা ভাবে লড়ে এমজিপি এবং গোয়া ফরওয়ার্ড পার্টি (জিএফপি) পায় ৩টি করে। নির্দল ও অন্যেরা পায় ৪টি। এমজিপি, জিএফপি এবং কয়েক জন নির্দলের সমর্থনে সরকার গড়ে বিজেপি। সহযোগী দুই দলকে দেওয়া হয় উপমুখ্যমন্ত্রিত্ব। কিন্তু পরে কংগ্রেস ভেঙে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাসিল করার পরে একে একে মন্ত্রিসভা থেকে সরানো হয় সহযোগী দুই দলকে। এ বার ভোটে জিএফপি কংগ্রেসের হাত ধরেছে। এমজিপি সহযোগী হয়েছে তৃণমূলের।
২০১৭-য় মণিপুরের ৬০টি আসনের মধ্যে ২৮টিতে জিতেছিল কংগ্রেস। ২১টি পেয়েছিল বিজেপি। আলাদা ভাবে লড়ে নাগা পিপলস ফ্রন্ট (এনপিএফ) ৪টি, ন্যাশনাল পিপল্স পার্টি (এনপিপি) ৪টি, লোকজনশক্তি পার্টি (এলজেপি), তৃণমূল এবং নির্দল একটি করে আসন পেয়েছিল। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ‘ম্যাজিক ফিগার’ ৩১ থেকে মাত্র তিনটি আসনে পিছিয়ে থেকেও ইম্ফলের কুর্সি দখল করতে পারেনি কংগ্রেস। অভিযোগ, রাজ্যপাল একক বৃহত্তম দলকে সরকার গড়ার সুযোগ দেননি। এলজেপি, এনপিপি, এনপিএফ-এর সমর্থন এবং তৃণমূলের বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার গড়ে মোদীর দল। এ বার অবশ্য সহযোগীদের দূরে সরিয়ে একার শক্তিতেই লড়ছে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের নেতৃত্বাধীন বিজেপি।
মণিপুরের সমতলে মৈতেই জনগোষ্ঠী বহুল ৪০টি আসনে মূল লড়াই বিজেপি বনাম কংগ্রেসের। অন্য দিকে পাহাড়ের ২০টি আসনে নাগা এবং কুকি জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় প্রভাব রয়েছে এনপিএফ এবং এনপিপি-র। প্রতিবেশী নাগাল্যান্ড এবং মেঘালয়ে ওই দুই দলের নেতৃত্বাধীন সরকারে রয়েছে বিজেপি। ফলে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না পেলেও এ বারও বিজেপি মণিপুরে সরকার গড়ার লড়াইয়ে এগিয়ে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকেই শুরু হল উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের গণনাপর্ব। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফলাফলের প্রবণতার আঁচ মেলার সম্ভাবনা। যা দেশকে এগিয়ে দেবে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের দিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy