গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
রেওয়াজ মেনেই রাজ বদলাল রাজস্থানে। রানি পদ্মিনীর রাজ্যে এখন টলটলে পদ্মবন। ১১৫টি আসন জিতে পুরনো কংগ্রেস সরকারকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে বিজেপি। কিন্তু কুর্সির দখল পাকা হতেই আলোচনা শুরু হয়েছে কুর্সির ‘দাবিদার’ নিয়ে। কে হবেন বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী? দাবিদারের দীর্ঘ তালিকার সামনে ধন্দে পড়েছেন রাজনৈতিক নজরদারেরাও।
বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নিয়ে আলোচনায় ‘অভিজ্ঞ’ একজনের নাম উঠে আসছিল ভোটের আগে থেকেই। তিনি বসুন্ধরা রাজে। রাজস্থানের পাঁচ বারের সাংসদ বসুন্ধরা রাজস্থানের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। তার উপর তিনি রাজকুমারী। রাজবধূও। গোয়ালিয়রের রাজা বিজয়রাজে শিন্ডের কন্যা বসুন্ধরা। বিয়ে করেছেন রাজস্থানের ঢোলপুরের রাজ পরিবারে। রাজ-রাজড়ার দেশ রাজপুতানায় এখনও রাজবংশের নাম শুনলে ভক্তিতে মাথা নোয়ান অনেকে। রাজবধূ বসুন্ধরা সেই আবেগকে নিজের দিকে টানতে পারতেন। কিন্তু গেরুয়া শিবিরে জোর খবর, রাজস্থানের দু’বারের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরার ‘প্রথম শ্রেণির’ যোগ্যতায় কাঁটা পড়েছে দিল্লি বিজেপির সঙ্গে তাঁর ‘মধুর’ সম্পর্কে।
রাজস্থানে রাজে-কাঁটা
এ ‘কাঁটা বেছে খাওয়া’ যাবে না! রাজনৈতিক মহলে প্রায় সকলেই জানেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বসুন্ধরার ‘ইগোর লড়াই’য়ের কথা। মোদী যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, সেই সময় বসুন্ধরাও ছিলেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী। নর্মদা নদীর জল ছাড়া নিয়ে দু’জনের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছিল সেই সময়ে। এক দিকে যখন মোদী বোঝাতে ব্যস্ত যে, তিনি নর্মদার জল ছেড়ে রাজস্থানের উপকার করছেন, তখন রাজে পাল্টা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বড় কোনও ‘দয়া’ করেননি মোদী। সম্প্রতি ভোটের প্রচারে এই দ্বন্দ্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন রাজ্যস্থানের বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত। তিনি বলেছিলেন, ‘‘মোদী এবং রাজের নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ের ভুক্তভোগী হয়েছে রাজস্থানের জনতা। এমনকি, এখনকার রাজস্থানে বিজেপিও সেই একই লড়াইয়ের শিকার’’।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, যাঁর সঙ্গে ‘দ্বন্দ্ব’, তাঁকে কি বিজেপি-শাসিত একটি রাজ্যের মাথায় বসিয়ে সমস্যা আরও জটিল করতে চাইবেন প্রধানমন্ত্রী মোদী! যদিও রাজস্থানের বিজেপি সূত্রে খবর, বসুন্ধরা তাঁর ‘ইগো’ ছেড়ে নমনীয়তা দেখিয়েছেন। রবিবারের গণনা শুরুর পর রাজস্থানে গেরুয়া ঝড় উঠতেই রাজে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, ‘‘এই জয়ের এক এবং একমাত্র কারণ প্রধানমন্ত্রী মোদীই’’। বসুন্ধরাপন্থীদের আশা, এতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে আনুগত্যের বার্তা দিতে পেরেছেন রাজে। যদিও রাজের প্রতিদ্বন্দ্বীদের দীর্ঘ তালিকা বলছে, রাজস্থানের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর পায়ের তলার মাটি বড় একটা শক্ত নয়।
রাজে বনাম রাজকুমারী
রাজের বদলে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে যাঁদের নাম উঠে আসছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম রাজস্থানের আরও এক রাজকুমারী। তিনি দিয়া কুমারী। বয়সে নবীন। সম্পর্কে মহারানি গায়ত্রী দেবীর নাতনি। তাঁর বাবা ভবানী সিংহ ছিলেন জয়পুরের মহারাজা সওয়াই মান সিংহের জ্যেষ্ঠপুত্র। গায়ত্রী দেবী সেই মান সিংহের তৃতীয় স্ত্রী। দিয়া তাঁর ঠাকুমার মতোই দেশের সাংসদ হয়েছেন। তার আগে তিনি ছিলেন রাজস্থান বিধানসভার বিধায়ক। তাঁকে বিজেপিতে যোগদান করিয়েছিলেন বসুন্ধরাই। বাবা কংগ্রেসের টিকিটে লোকসভা ভোটে লড়লেও দিয়া বিজেপির পতাকা তুলে নিয়েছিলেন বসুন্ধরা এবং দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের হাত থেকে। দিয়া এবং বসুন্ধরা দু’জনেই রাজ পরিবারের কন্যা। পাশাপাশিই দিয়ার সমর্থকেরা বলেন, বসুন্ধরার দুর্বলতা যেখানে, সেখানেই নাকি দিয়ার শক্তি। তিনি দিল্লি নেতৃত্বের অত্যন্ত অনুগত। তবে সমালোচকদের বক্তব্য, ‘‘দিয়া রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন ২০১৩ সালে। সবে ১০ বছর হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার। এত কম অভিজ্ঞতার একজনকে মুখ্যমন্ত্রী করলে তিনি দিল্লির হাতের পুতুল হয়েই থাকবেন। তবে দিল্লির বিজেপি নেতৃত্ব সম্ভবত সেটাই চান।’’
রাজস্থানের যোগী
রাজা-রাজড়ার সঙ্গে দেশের মুখ্যমন্ত্রিত্বের দৌ়ড়ে রয়েছেন এক যোগীও। বিজেপি সূত্রে খবর, দুই রাজকুমারীর থেকে বরং মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে কিছুটা এগিয়ে রয়েছেন এই সুদর্শন যোগী। নাম যোগী বালকনাথ। নিজেকে রাজস্থানের যোগী বলে পরিচয় দেন মস্তনাথ মঠের এই মহন্ত বালকনাথ। যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে তাঁর। তিনিও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর মতোই ‘নাথ’ সম্প্রদায়ভুক্ত। ব্রহ্মচারী। গেরুয়াধারী। মাত্র ছ’বছর বয়সে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। তাঁর ভক্তেরা বলেন, তার পর থেকে সমাজের কল্যাণেই নিজেকে উৎসর্গ করেছেন রাজস্থানের যোগী। আবার রাজস্থান বিজেপির সহ-সভাপতিও তিনি। মরুরাজ্যের বিজেপি নেতাদের অনেকেই বলেছেন, সুদর্শন এই যোগীর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ প্রথমত, বিজেপির ‘যোগী ফর্মুলা’ ইতিমধ্যেই সফল হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। ফলে উত্তর ভারতের হিন্দিবলয়ে এই সমীকরণ যাকে বলে ‘পরীক্ষিত’। তা ছাড়া রাজস্থানেও এক যোগীকে মুখ্যমন্ত্রী করার আরও একটি কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছে বালকনাথ শিবির। সেটি হল তাঁর সন্ন্যাসীর জীবন। পরিবার না থাকায় নিজের পুরো সময়টাই রাজস্থানের প্রশাসনে দিতে পারবেন যোগী।
আরও অনেকে রয়েছেন
রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এঁরা ছাড়াও রয়েছেন আরও অন্তত চার জন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা রাজপুত নেতা গজেন্দ্র সিংহ শেখাবত, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘাওয়াল, রাজস্থান বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি সতীশ পুনিয়া, বিজেপি সাংসদ সিপি যোশী এবং অলিম্পিক্স পদকজয়ী বিজেপির লোকসভা সাংসদ রাজ্যবর্ধন রাঠৌড়। এঁদের মধ্যে কাকে বিজেপি রাজস্থানে নিজেদের মুখ্যমন্ত্রী এবং উপমুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বেছে নেবে, সে প্রশ্ন করতে রাজ্যবর্ধন জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে দল যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেবে।
যদিও নিন্দকেরা বলছেন, রাজস্থানের জয় তো প্রথা মেনে এ বার বিজেপিরই হওয়ার কথা ছিল। কারণ, গত ৩৮ বছর ধরে তেমনটাই হয়ে আসছে। প্রতি বছর শাসকের বিরোধী ভোটই পড়ে রাজস্থানে। সে শাসনে যে দলই থাকুক। কিন্তু রাজস্থানে বিজেপির আসল লড়াই শুরু হবে এ বার। ৭-৮ জন দাবিদারের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়া তো মুখের কথা নয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy