এ দেশে সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল মনমোহনের নাম। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের প্রয়াণের পর প্রণব মুখোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল— রাওয়ের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব কী বলে আপনার মনে হয়? প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ‘‘মনমোহন সিংহকে আবিষ্কার করা।’’
ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস বলছে, এখনও পর্যন্ত জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী এবং নরেন্দ্র মোদী ছাড়া মনমোহনই দীর্ঘতম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন। ২০০৪ থেকে ২০১৪। একটানা ১০ বছর। তা ছাড়া, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত নরসিংহ রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও সামলেছেন তিনি। সামলেছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর, যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান, রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতার পদও। অবিভক্ত পঞ্জাবের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে তাঁর জীবনের যাত্রা শুরু। দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে শরণার্থী হয়ে চলে আসেন ভারতে। কৃতী ছাত্র, নামী শিক্ষক, উচ্চপদে নানা চাকরি থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে উঠে আসা— সব মিলিয়ে মনমোহনের জীবন এক চমকপ্রদ উত্থানের কাহিনি। তবে মনমোহন সিংহ নামটা দেশ তথা বিশ্বের সামনে সজোরে এসে পড়ে ১৯৯১ সালে, তিনি দেশের অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর।
রাওয়ের জমানায় অর্থমন্ত্রী হিসাবে দেশের আর্থিক সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছে মনমোহনের নাম। অর্থনীতির সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পুরোদস্তুর সরকারি নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে বেসরকারি পুঁজি, ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশি পুঁজিকেও জায়গা করে দেওয়ার রাস্তা তৈরি হয়েছিল মনমোহনের হাতে। পাঁচ বছর অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন তুমুল বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। এক দিকে প্রবল নিন্দা আর প্রতিবাদ, অন্য দিকে দু’হাত তুলে প্রশংসা আর সমর্থন।
ঘটনাচক্রে, মনমোহন দেশের অর্থমন্ত্রী হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ভেঙে পড়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে দুই ‘মহাশক্তিধর’ আমেরিকা আর সোভিয়েত রাশিয়ার ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ভারত সোভিয়েত-বন্ধু হিসাবে পরিচিত ছিল। দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বের এই ভরকেন্দ্র প্রথম বদলাতে শুরু করে অর্থমন্ত্রী হিসাবে মনমোহনের একের পর এক নীতি বা সিদ্ধান্তের হাত ধরে। নতুন ভাবে দানা বাঁধতে শুরু করে ভারত আর আমেরিকার সম্পর্ক। ১৯৪৭ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত ৫২ বছরে মাত্র তিন জন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ভারত সফরে এসেছেন। কিন্তু পরের ২২ বছরে ভারত সফর করেছেন আমেরিকার চার জন প্রেসিডেন্ট। বিল ক্লিন্টন ২০০০ সালে এ দেশে আসেন। এর পর তাঁর প্রত্যেক উত্তরসূরি এসেছেন ভারতে। বারাক ওবামা এসেছেন দু’বার।
অর্থমন্ত্রী মনমোহনের নীতি সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়ে বামপন্থীদের। আবার সেই বামেদের সমর্থনেই কিন্তু ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। তবে সেই ‘মধুচন্দ্রিমা’ প্রথম ইউপিএ সরকারের শেষ পর্যন্ত টেকেনি। ২০০৮ সালে ভারত-আমেরিকা পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে বামেরা। বামেদের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করেই আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি সইয়ের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন মনমোহন। তাঁর সরকারের উপর থেকে বামেরা সমর্থন তুলে নেয়। যদিও আস্থাভোটে জিতে টিকে যায় তাঁর সরকার।
‘নরম’ বা ‘দুর্বল’ মনমোহনের এই কঠোর সিদ্ধান্ত দেশ কিন্তু একাধিক বার প্রত্যক্ষ করেছে। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শরিক তৃণমূলের সমর্থন প্রত্যাহারের পরেও খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির দরজা খোলার সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছেন তিনি। প্রথম এবং দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এমন বেশ কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁর সরকার। বিজেপি নেতৃত্ব তাঁর মিতভাষী স্বভাবকে কটাক্ষ করে বার বার ‘মৌনীমোহন’ বা ‘দুর্বল প্রধানমন্ত্রী’ বললেও দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘সিং ইজ কিং’।
আর্থিক সংস্কারের পাশাপাশি গরিব জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার বিষয়টিকেও মনমোহন নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প তাঁর সরকারেরই অবদান।
ভারতের ইতিহাসে মনমোহনই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, যিনি আগে নিজের অবসরের কথা ঘোষণা করেছিলেন। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভোটের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, তিনি আর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকবেন না।
মনমোহনের ব্যক্তিগত সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে কোনও দিন প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায়নি বিরোধীরা। কিন্তু তাঁরই জমানায় টু-জি স্পেকট্রাম, কমনওয়েলথ গেমস, কয়লা, কপ্টার, আস্থা-ঘুষ, আদর্শ আবাসন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আর সেই অভিযোগকে হাতিয়ার করে দানা বেঁধেছে লোকপালের দাবিতে আন্দোলন। অণ্ণা হজারেদের সেই ‘অরাজনৈতিক’ আন্দোলনকে সিঁড়ি করে ‘আম আদমি পার্টি’-র মতো দলের উত্থান এবং প্রতিষ্ঠা হয়েছে নাগরিক সমাজে। পরবর্তী কালে টু-জি বণ্টন নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগকে খারিজ করেছে আদালত। কিন্তু তত দিনে রাজনৈতিক ভাবে বড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে কংগ্রেসের।
রাজ্যনৈতিক জীবনে ‘মিস্টার ক্লিন’ হিসাবে পরিচিত মনমোহনকে সম্ভবত ব্যক্তিগত স্তরে সবচেয়ে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন ৭, রেসকোর্স রোডে তাঁরই উত্তরসূরি নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। ২০১৬-য় রাজ্যসভায় রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা বিতর্কের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর পূর্বসূরিকে নিশানা করে বলেন, ‘‘ডক্টর সাহাবের থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। এত কেলেঙ্কারির একটি দাগও তাঁর গায়ে লাগেনি। বর্ষাতি পরে কী করে স্নান করতে হয়, তা ডক্টর সাহাব জানেন!’’ এর পর ২০১৭-য় গুজরাতে বিধানসভা ভোটের প্রচারসভায় মোদী অভিযোগ করেছিলেন, বিজেপিকে হারাতে মণিশঙ্কর আইয়ারের বাড়িতে পাকিস্তানের লোকেদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মনমোহন!
তবে অনেকে বলে থাকেন, বিজেপি বা অন্য বিরোধীরা নয়, মনমোহনকে সবচেয়ে বড় হেনস্থা করেছে তাঁর দল কংগ্রেসই! ২০১৩ সালে কংগ্রেসের সাংবাদিক বৈঠক করে রাহুল গাঁধী বলেছিলেন, ‘‘সাজাপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিদের পদে রাখার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার যে অর্ডিন্যান্স জারি করেছে, সেটা একেবারে ফালতু। ওটা এখনই ছিঁড়ে ফেলা উচিত।’’ বলেন এবং সর্বসমক্ষে ইস্তাহার ছিঁড়েও ফেলেন রাহুল! ঘটনাচক্রে, সে সময় কেন্দ্রে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন! তিনি তখন বিদেশসফরে। কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ শিষ্টাচার বোধের নজির রেখেই রাহুলের মন্তব্যের জবাব দেননি ‘সর্দার’। যেমন কখনও জবাব দেননি মোদীর ব্যক্তিগত আক্রমণেরও।
আক্ষরিক অর্থেই নীল পাগড়ির সর্দার’জি ছিলেন ‘লাস্ট অব দ্য মোহিকান্স’। তাঁর জীবনাবসানে ভারত হারাল এক বিরল ভদ্র, শিক্ষিত এবং নম্র রাজনীতিককে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy