Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Afghanistan War

Taliban: ‘তালিবান ভয়ঙ্কর! তুমি এখনই পালাও, আফগান বন্ধুর ফোন পেয়ে দিল্লির টিকিট কাটলাম’

কাবুলের এক বহুজাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করতেন সোহিনী সরকার। কোন পরিস্থিতিতে কাবুল ছাড়লেন, তা নিয়েই লিখলেন এই প্রতিবেদন।

বার্তা আসতে লাগল, তালিবান বাহিনী কাবুলে ঢুকে বন্দিদের মুক্ত করছে।

বার্তা আসতে লাগল, তালিবান বাহিনী কাবুলে ঢুকে বন্দিদের মুক্ত করছে। ছবি রয়টার্স।

সোহিনী সরকার
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২১ ০৫:৩৩
Share: Save:

চারদিকে কাগজ পোড়ার গন্ধে যেন দম আটকে আসছে। কাজ গুটিয়ে কাবুল বিমানবন্দরের দিকে দৌড়ব, তার আগে অফিসের সর্বত্র এই কটু গন্ধ।

শনিবার, ১৪ অগস্ট, আমেরিকার দূতাবাস থেকে আমাদের কাছে বার্তা এল— যত দ্রুত সম্ভব সব কাজ শেষ করে বেরিয়ে যেতে হবে। আর বেরোনোর আগে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়িয়ে দিতে হবে। কথামতো কাজ। আফগান সতীর্থরা জলভরা চোখে বলছেন, তাঁদের জন্য প্রার্থনা করতে। যাঁরা আমাদের কাছ থেকে সুযোগসুবিধা পান, যাঁদের সঙ্গে আমরা কাজ করি— কাগজপত্র নষ্ট করতে করতেই হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছি তাঁদের। অন্তত ২০০ জন সহকর্মীকে ফেলে এলাম পিছনে, আজ যাঁদের জীবন বিপন্ন।

গত সপ্তাহে আমার কাছে কাবুল থেকে আমেরিকা ফিরে যাওয়ার দু’টি টিকিট ছিল। একটি ১৭, অন্যটি ২১ অগস্টের। আমরা সকলেই ভেবেছিলাম, এই মাসের শেষে আমেরিকান সেনা ফিরে যাওয়ার আগে তালিবান কাবুল দখল করবে না। আমি চাইছিলাম, শেষ দিন পর্যন্ত কাজটা চালিয়ে যেতে। কিন্তু কন্দহরের পতনের পরে তালিবান যেন ঝড়ের মতো এগিয়ে আসতে লাগল। বুঝতে পারলাম, যত দ্রুত সম্ভব কাবুল ছাড়তে হবে।

শুক্রবার সকালে এক জন আফগান-আমেরিকান সহকর্মী আমাদের আমেরিকার সদর দফতর থেকে ফোন করলেন। বললেন, “আর দেরি করা যাবে না। তালিবান ভয়ঙ্কর। ওদের বিশ্বাস নেই। তুমি পালাও।” এত সব শুনেও কিছুটা গা ছাড়া ভাবেই ১৫ অগস্ট রবিবারের দিল্লি যাওয়ার টিকিটটা জোগাড় করলাম। কারণ, ১৩ তারিখের পরে কাবুল থেকে আমেরিকা যাওয়ার টিকিট প্রায় ছিলই না। শুধু বিজ়নেস ক্লাসের কিছু টিকিট পড়ে ছিল। তাই দিল্লির টিকিটটা কেটে রাখলাম, অগতির গতি হিসেবে। তখনও ভেবে যাচ্ছি, রবিবারের দিল্লির টিকিটটার দরকার পড়বে না, আগের পরিকল্পনা মাফিক ২১ তারিখেই আমেরিকা ফিরব। আজ টিভিতে কাবুল বিমানবন্দরের ভয়াবহ সব ছবি দেখে মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস ওই টিকিটটা কেটেছিলাম।

কাবুলের রাস্তায় তালিবানিরা।

কাবুলের রাস্তায় তালিবানিরা। ছবি রয়টার্স।

শনিবার রাত থেকে সব কিছু বদলে যেতে শুরু করল। আমাদের নিরাপত্তা দল এবং আফগান সহকর্মীদের কাছ থেকে বার্তা আসতে লাগল, তালিবান বাহিনী কাবুলে ঢুকে বন্দিদের মুক্ত করছে। সেই রাতেই কাবুল অন্ধকারে ঢেকে গেল। লোকে বলতে শুরু করে, তালিবান ‘পাওয়ার গ্রিড’ নষ্ট করে দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি।

পরের দিন সকালে অফিসে পৌঁছতেই জানানো হল, তালিবান বাহিনী রাজধানীতে ঢুকে পড়েছে। ফলে আগের পরিকল্পনা বদলে ঘণ্টা দেড়েক আগে এয়ারপোর্টে দৌড়তে হবে। তাড়াতাড়ি কিছু কাজ সারলাম, যাতে স্থানীয় কর্মীরা সবেতন ছুটি পেতে পারেন। এরই মধ্যে আফগান সহকর্মীরা জানালেন, ব্যাঙ্কগুলোয় টাকা নেই। এয়ারপোর্টের দিকে দৌড়তে দৌড়তেই দেখলাম রাস্তায় থিকথিক করছে গাড়ি, প্রাইভেট ট্যাক্সি। সবার লক্ষ্য এয়ারপোর্ট। এমনিতে পৌঁছতে দশ মিনিট লাগার কথা, লাগল ৪৫ মিনিট। টার্মিনালে পৌঁছে দেখি দক্ষযজ্ঞ চলছে, তবে মোটামুটি একটা নিয়ম রয়েছে তখনও। বিরাট লম্বা লাইন। অনেকেরই ঠিক মতো কাগজ নেই, ভিসা নেই, এমনকি ঠিকঠাক পাসপোর্টও সঙ্গে নেই। কিন্তু সবাই চাইছেন, যে ভাবে হোক বেরিয়ে যেতে। বিমানবন্দর এবং এয়ারলাইন্সের কর্মীরা অসম্ভব ধৈর্য এবং সাহসের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন। রয়েছেন এয়ার ইন্ডিয়ার কর্মীরাও। প্রিন্টার, কম্পিউটার সব ভেঙে গিয়েছে। এয়ারলাইন্সের এক কর্মী আমাকে বাড়তি লাগেজের একটা স্ক্রিনশট দেখালেন। যাঁদের কাছে ঠিকঠাক টিকিট এবং ভিসা রয়েছে তাঁরাও আতঙ্কিত। কারণ খবর ছড়াচ্ছে, যে কোনও সময় উড়ান বাতিল হয়ে যেতে পারে। কাবুলের টারম্যাকে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান নামতে দেখে অন্যদের মতো আমিও উত্তেজিত। তা হলে এখনও বাঁচার ক্ষীণ আশা রয়েছে! কাবুল বিমানবন্দরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রয়েছেন বেশ কিছু ভারতীয়। এঁদের বাড়ি সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে। তাঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁরাও চাইছেন যে ভাবে হোক পালাতে।

ঠিক যখন বিমানবন্দর ছাড়ব, দেখলাম ভিড়ের ঢেউ আছড়ে পড়ছে পিছনে। দলে দলে মানুষ দৌড়ে আসছেন। তাঁদের পিছনে ফেলে আমরা বিমান উঠে বসলাম। একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে বিমানটি শূন্যে উঠে পড়ার পরই চার দিকের ভৌতিক নীরবতা ভাঙল ফুঁপিয়ে ওঠার সমবেত শব্দে। অনেকেরই চোখে জল। আমার পাশেই বসেছিলেন এক জন মহিলা সাংসদ। তিনি দেশ ছাড়তে পারলেন। কিন্তু তাঁর বন্ধুরা, যাঁদের মধ্যে এক জন নামকরা সাংবাদিকও রয়েছেন, আটকে রইলেন বিমানবন্দরেই। উপর থেকে দেখলাম— তখনও আফগানিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়ছে। চোখে জল এল আমারও। জানি না, ফের কবে এই পতাকা আবার দেখতে পাব।

(কাবুলের এক বহুজাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কর্মরত)

অন্য বিষয়গুলি:

Afghanistan War taliban Afghanistan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy