গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
দেশ জুড়ে করোনার আক্রমণ এবং তার মোকাবিলায় লকডাউনে অর্থনীতির উপর ধাক্কা অভিশাপ হয়ে নেমেছে বুন্দেলখণ্ডের চিত্রকূটে। এতটাই যে, লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে খনিতে, খাদানে কাজ করতে হচ্ছে কিশোরীদের। কিন্তু হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও ন্যায্য মজুরি হাতে পাচ্ছে না তারা। বরং নিজেদের পরিশ্রমের টাকা পেতে কখনও একজন, কখনও বা একসঙ্গে অনেককে শরীর দিয়ে খুশি করতে হচ্ছে তাদের।
নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সংসারে। দু’বেলা ভাতও জোটে না ঠিক মতো। এমন অবস্থায় স্কুলে যাওয়ার মতো বিলাসিতা কি চলে? বইপত্র ফেলে তাই মাথায় ঝুড়ি তুলে নিয়েছিল বছর চোদ্দর বিন্দিয়া (নাম পরিবর্তিত)। দু’টো গ্রাম ছাড়িয়ে পাথর ভাঙার কাজ জুটিয়ে ফেলেছিল বাপ মরা মেয়েটি। কিন্তু শুধু পরিশ্রম করলেই যে পয়সা রোজগার হয় না, তা বুঝতে একটু সময়ই লেগেছে বিন্দিয়ার। দিনভর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর বাকিরা পাওনা নিয়ে চলে গেলেও, অপেক্ষা করতে হয় তাকে। সকলে চলে গেলে একান্তে বাবুকে খুশি করতে হয়। তবেই এক-দেড়শো টাকা হাতে আসে তার।
দিল্লি থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরে বুন্দেলখন্ডের চিত্রকূট এলাকার একটা বড় অংশ জুড়ে জনজাতি মানুষের বাস। বেআইনি খনি এবং পাথরের খাদানই তাদের রোজগারের একমাত্র ভরসা। পেটের তাগিদে এ ভাবেই সেখানে একধাক্কায় ‘বড়’ হয়ে যায় বিন্দিয়ারা। রোজ ২০০-৩০০ টাকা রোজগারের আশায় কাজে ঢোকে তারা। তার উপর দিতে হয় দালালিও। তাতে দিনের শেষে এক-দেড়শো টাকা হাতে পড়ে থাকে তাদের। কিন্তু সেই পাওনা হাতে পেতে কখনও ঠিকেদার কখনও আবার ম্যানেজারদের সামনে শরীর মেলে দিতে হয় তাদের।
আরও পড়ুন: সেনামুক্ত হটস্প্রিং, গালওয়ানে কাল শেষ হবে সেনা অপসারণ
কপাল ভাল থাকলে এক জনকে খুশি করেই টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারে বিন্দিয়ারা। কিন্তু কখনও কখনও একসঙ্গে অনেক জনকে খুশি করার ভার পড়ে তাদের উপর। কিন্তু টাকা না নিয়ে যে বাড়ি ফিরে যাবে সেই উপায়ও নেই। মুখের উপর না বললে পাহাড়ের উপর থেকে ছুড়ে ফেলার হুমকি দেওয়া হয় তাদের। তাই রাত বাড়লেও মেয়ে যখন ফেরে না, সব জেনেও প্রহর গুনতে থাকে বাড়ির লোকজন। আর লাগাতার অত্যাচার সয়েও শুধুমাত্র বাড়ির লোকজনের মুখ চেয়ে প্রতিদিন কাজে যেতে হয় বিন্দিয়াদের। লকডাউনে পারিবারিক অভাব সেই ছবিটাকে আরও করুণ করেছে।
চিত্রকূট, দাফাই-সহ উত্তরপ্রদেশের জনজাতিপূর্ণ প্রায় সব এলাকাতেই ছবিটা একরকম। দালাল, ঠিকাদারদের হাতে পড়ে, ১২-১৪ বছর বয়স থেকে শরীরের বিনিময়ে পাওনা আদায় করা শিখতে হয় তাদের। লকডাউনে আরও কঠিন হয়েছে জীবন ধারণ। কাজ ছিল না বেশ কিছু দিন। এখন শরীর দেওয়ার শর্তে রাজি হলে তবেই তাদের কাজে ঢোকানো হয় বলেও জানা গিয়েছে। করভি গ্রামের বাসিন্দা সৌম্যা (নাম পরিবর্তিত)নামের এক কিশোরীর দাবি, এক খনির ঠিকাদারের কাছে কাজ চাইতে গিয়েছিল সে। কাজ পেতে হলে বিনিময়ে তাকেও আপসে আসতে হবে বলে শুরুতেই সৌম্যাকে জানিয়ে দেয় ওই ঠিকাদার।
তবে তাদের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করলেও ওই ঠিকাদাররা কখনও নিজেদের নামধাম প্রকাশ করে না বলে জানিয়েছে দাফাই গ্রামের রিঙ্কু (নাম পরিবর্তিত)। তার কথায়, ‘‘কাজ পেতে গেলে ওদের শর্ত মানা ছাড়া উপায় নেই। পরিবারের কথা ভেবে আমরাও রাজি হয়ে যাই। ওরা অনেক টাকার লোভ দেখায়। কখনও কখনও একসঙ্গে অনেকে মিলে অত্যাচার করে। রাজি না হলে, পাহাড় থেকে ছুড়ে ফেলার হুমকিও দেয়।’’
আরও পড়ুন: ফেব্রুয়ারিতে দিনে ৩ লাখ করে সংক্রমণ বাড়বে ভারতে? দাবি গবেষণার
মেয়ের উপর কী অত্যাচার চলে, তা ভাল করেই জানেন রিঙ্কুর মা। কিন্তু এ ছাড়া আ কী ভাবে পেটের জোগান দেবেন, তা জানা নেই তাঁর। রিঙ্কুর মা বলেন, ‘‘আমরা নিরুপায়। তিন-চারশো টাকা রোজ হিসেবে কাজে ঢোকায় ওরা। কিন্তু কখনও দেড়শো, কখনও দু’শো টাকাই হাতে ধরায়। মেয়ে বাড়ি ফিরলে সবকিছু জানেত পারি। কিন্তু কী করব? আমরা শ্রমিক। পেটের জোগান তো দিতে হবে? আমার স্বামী অসুস্থ। তার ডাক্তারের খরচও রয়েছে।’’ একটানা লকডাউনের জেরে এই মুহূর্তে কাজের যা অবস্থা, তাতে ঠিকেদাররা আরও সুযোগ নিচ্ছে বলেও জানান তিনি।
কোল জনজাতি পূর্ণ চিত্রকূটের পাহাড়ি এলাকায় এই মুহূর্তে ৫০টি পাথরের খাদানে কাজ চলছে। ভারতীয় সংবিধান এবং আইন সেখানে খাটে না বললেই চলে। এমন পরিস্থিতিতে লাগাতার সেখানে যৌন নির্যাতনের শিশু ও মহিলারা। ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে বহু মহিলা খাদানে কাজে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। নিজের মেয়েদেরও কাজে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁরা। সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম তাঁদের এই দুরাবস্থার ছবিটি তুলে ধরে।
তাতে বিষয়টি বেআইনি খনি এবং খাদানগুলির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন চিত্রকূটের জেলাশাসক শেশমণি পান্ডে। তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের অভিযোগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ করি আমরা।’’ কিন্তু অধিকাংশ সময়ে যে কোনও অভিযোগ জমা পড়ে না, তা-ও মেনেছেন তিনি। উত্তরপ্রদেশ শিশু অধিকার ও নিরাপত্তা কমিশনের চেয়ারপার্সন বিশেষ গুপ্তও বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের নাকের ডগায় দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের অমানবিক ঘটনা ঘটতে থাকলেও, এ ব্যাপারে অভিযোগ তাঁরা পাননি বলে দাবি চিত্রকূটের এএসপি আর এস পান্ডের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy