১৯৮৫। সংসদীয় সচিব পদে (বাঁ দিক থেকে) অরুণ সিংহ, অস্কার ফার্নান্ডেজ় এবং আহমেদ পটেলকে শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী। ফাইল চিত্র।
কংগ্রেস নেতাদের মোবাইলে ফোন যেত রাত দেড়টা-দুটো নাগাদ। অল্প কথায় জানিয়ে দেওয়া হত ‘ম্যাডাম’-এর নির্দেশ। কিংবা জানতে চাওয়া হত বিশেষ কোনও তথ্য। বেশি রাতে মোবাইল বাজলেই কংগ্রেস নেতারা বুঝে যেতেন, ফোনের ও প্রান্তে আহমেদভাই।
ইউপিএ-সরকারের দশ বছর তো বটেই, কংগ্রেস সভানেত্রী হিসেবে সনিয়া গাঁধীর প্রায় গোটা ইনিংসেই আহমেদ পটেল তাঁর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। কিন্তু তা নিয়ে কোনও দিন বড়াই করেননি। দলে সনিয়া গাঁধী তথা গাঁধী পরিবারের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্যের যে সংস্কৃতি, তার সবচেয়ে বড় প্রতীক ছিলেন তিনিই। সনিয়ার সঙ্গে ইউপিএ-সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের তিনিই ছিলেন প্রধান যোগসূত্র। আবার রাহুলের জমানায় সনিয়ার অনুগামী প্রবীণ নেতৃত্বের সঙ্গে রাহুল-অনুগামী তরুণ প্রজন্মের যোগসূত্রও হয়ে উঠেছিলেন আহমেদ পটেল।
বুধবার ভোর রাতে গুরুগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালে আহমেদ পটেলের মৃত্যুর পরে সনিয়া গাঁধী তাই প্রত্যাশিত ভাবেই বলেছেন, “আমি এমন এক কমরেডকে হারালাম, যাঁর জায়গা কেউ নিতে পারবে না। একজন বিশ্বস্ত সহকর্মী, বন্ধুকেও হারালাম।’’ আহমেদের পুত্র ফয়জলকে শোকবার্তায় রাহুল জানিয়েছেন, ‘ওঁর পরামর্শ, বুদ্ধিমত্তা, কংগ্রেস পার্টির প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব বোধ করব।’ কংগ্রেসের নেতারা মনে করছেন, আহমেদের প্রয়াণে কংগ্রেসের দুই প্রজন্মের মধ্যে যোগসূত্রটাই ছিঁড়ে গেল। তার ফল কী হয়, এখন সেটাই দেখার। ইউপিএ-সরকারের শেষ পর্বে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু আহমেদ পটেল তার আঁচ সনিয়া বা গাঁধী পরিবারের দিকে আসতে দেননি। আবার কংগ্রেসের রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় থেকেও সনিয়াকে আগলে রেখেছেন। কংগ্রেস নেতারা বলছেন, রাহুলের জমানায় আহমেদের সেই শূন্যস্থান কেউ পূরণ করতে পারেন কি না, সেটাই দেখার।
ভদ্র ব্যবহারের জন্য আহমেদ পটেলের সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতাদেরই মধুর সম্পর্ক ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শরদ পওয়ারের মতো আঞ্চলিক দলের নেতানেত্রীদের সঙ্গে আহমেদের সুসম্পর্ক সনিয়ার কাছেও রাজনৈতিক সম্পদ ছিল। মমতা এ দিন শোকবার্তায় আহমেদের সেই ‘শান্ত, অমায়িক স্বভাব’-এর কথাই স্মরণ করেছেন।
সনিয়ার থেকে রাহুলের হাতে কংগ্রেসের ব্যাটন যাতে মসৃণ ভাবে হস্তান্তর হয়, আহমেদ পটেল আড়ালে থেকে তা নিশ্চিত করেছিলেন। রাহুলের সঙ্গেও একই আনুগত্য নিয়ে কাজ করতে তৈরি ছিলেন। সভাপতির পদে বসার পর রাহুল তাঁর তৈরি ‘কংগ্রেস সিস্টেম’ ভাঙতেই উদ্যত দেখে আহমেদ সরে দাঁড়ান। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে লড়াইয়ের রসদ জোগাড়ে আহমেদ পটেলেরই ডাক পড়েছিল কোষাধ্যক্ষর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। দলের অন্দরের খবর, তিনি কয়েকটা ফোন ঘোরালেই কংগ্রেসের সিন্দুকে টাকা চলে আসত। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনও দিন দলের এক টাকাও নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠেনি।
লোকসভা ভোটে হারের দায় নিয়ে রাহুল গাঁধীর পদত্যাগের পর থেকে ক্রমশ টিম রাহুলের সঙ্গে আহমেদ পটেল ও অন্যান্য প্রবীণ নেতাদের বিরোধ চরমে ওঠে। আহমেদ অন্যদের মতোই মনে করতেন, নরেন্দ্র মোদীকে ব্যক্তিগত নিশানা করলে আদতে তাঁরই লাভ। কিন্তু রাহুলের বিশ্বাস, মোদীর ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ভাবমূর্তিটাই আগে ভাঙা দরকার। নবীন বনাম প্রবীণের এই লড়াইয়ে কোণঠাসা সচিন পাইলট যখন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার মতো বিজেপির দিকে পা বাড়াতে উদ্যত, তখন আবার আহমেদ পটেলকেই সচিনকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে দেখা গিয়েছিল। অশোক গহলৌত ও সচিন, দুই প্রজন্মের সেতুবন্ধন করিয়েছিলেন।
রাহুল গাঁধী বুধবার গুয়াহাটিতে প্রয়াত নেতা তরুণ গগৈকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন। দিল্লি ফিরেই তিনি ২৩ নম্বর মাদার টেরিজা ক্রেসেন্টে আহমেদের বাড়িতে পৌঁছে যান। বলেন, ‘সবথেকে কঠিন সময়েও উনি কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছেন।’ কংগ্রেসের ২৩ জন বিক্ষুব্ধ নেতা গত অগস্টে সনিয়া গাঁধীকে চিঠি লিখে কার্যত তাঁর নেতৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন। সনিয়া ‘আহত’ হয়ে অন্তর্বর্তী সভানেত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান। সে সময়ও আহমেদ গাঁধী পরিবারের হয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নেমেছিলেন। বুধবার সেই বিক্ষুব্ধদের অন্যতম কপিল সিব্বলকে আহমেদের বাসভবনে দেখা গিয়েছে, সজল চোথে। সেপ্টেম্বরে সনিয়া দলের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনায় ছয় সদস্যের কমিটি তৈরি করেন। আহমেদ পটেলকে নিয়েই সেই কমিটি তৈরি হয়েছিল।
আরও পড়ুন: অযোধ্যা বিমানবন্দর এ বার রামের নামে, পরিবর্তনে সায় দিল যোগী সরকার
আদতে রাজীব গাঁধীর আস্থাভাজন হিসেবে কংগ্রেসে উত্থান আহমেদ পটেলের। অরুণ সিংহ, অস্কার ফার্নান্ডেজ ও আহমেদ পটেলকে তাঁর সংসদীয় সচিবের দায়িত্ব দিয়েছিলেন রাজীব। তিন জনকে বলা হত ‘অমর-আকবর-অ্যান্টনি।’ মুসলিম হলেও আহমেদ সেই অর্থে কংগ্রেসের মুসলিম নেতা ছিলেন না। সনিয়া গাঁধীর বিশ্বস্ত সৈনিক হিসেবে কংগ্রেসের প্রধান কৌশলী হিসেবে কাজ করলেও তাঁর নিজের গড় গুজরাতে কংগ্রেস ২২ বছর ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু কংগ্রেসের নেতারা মানছেন, ইন্দিরা-রাজীবের পরবর্তী জমানায় সনিয়া-রাহুল ছাড়া গাঁধী পরিবারের বাইরের আর কেউ দলে আহমেদ পটেলের মতো ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেননি।
আরও পড়ুন: বিহারে স্পিকার পদ দখলে নিয়ে ‘চক্রব্যূহ’ দৃঢ় করল বিজেপি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy