গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
ভারতীয় সেনায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রকল্প, অগ্নিপথের বিরোধিতায় দেশ জুড়ে বিক্ষোভ। জ্বলছে ট্রেন-বাস, রেল স্টেশন। দাউদাউ বিক্ষোভের আগুনের কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে কি মিশে আছে গভীর রাজনৈতিক কোনও বার্তা? এই প্রশ্ন উঠছে কারণ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের নিজস্ব এই প্রকল্পের জেরে তৈরি হওয়া সামগ্রিক অস্থিরতা সামাল দিতে রাতারাতি অমিত শাহের মন্ত্রক এবং বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্য সরকারের প্রবেশ। তা হলে কি তরুণদের বিক্ষোভে সিঁদুরে মেঘ দেখছে শাসক বিজেপি?
অগ্নিপথের বিরোধিতার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে মূলত উত্তর ভারতের গো-বলয় বলে পরিচিত বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানায়। ঘটনাচক্রে, যে সমস্ত রাজ্য শাসনের ভার বিজেপি বা বিজেপি জোটের হাতে। লোকসভাতেও বিজেপির এই সব রাজ্য থেকে রমরমা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কম বয়সিদের এই চড়া দাগের আন্দোলনের জেরে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষতি কতটা হবে বা আদৌ হবে কি না, তার জোর হিসাব কষা চলছে রাজধানীর দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গে বিজেপির সদর দফতরে। সূত্রের খবর, কতিপয় বিজেপি নেতা একে বিরোধী পরিচালিত অশান্তি বা ‘ডিজাইন’ বলে অভিহিত করলেও, দলগত ভাবে তাতে সায় নেই বিজেপির। বরং, গেরুয়া শিবির মনে করছে, কিছু ঘটনায় কিছু মদত থাকলেও, তরুণ সমাজের এই আন্দোলন মূলত স্বতঃস্ফূর্ত। এই বিক্ষোভকারীদের একটা বড় অংশ বিজেপি বা তার সহযোগীদের ভোটব্যাঙ্ক। এটাই রক্তচাপ বাড়াচ্ছে বিজেপির। রক্তচাপ যে বাড়ছে তার প্রমাণ, বিক্ষোভের প্রথম দিন থেকে শনিবার পর্যন্ত এক পা এক পা করে পিছু হটেছে কেন্দ্র।
সেনায় বহু প্রতীক্ষিত সংস্কার নিয়ে আপত্তির কিছু দেখছেন না বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। কিন্তু অনেকেরই মত, মূল সমস্যাটি এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে। প্রয়োগের ভুলের কারণে কি বিজেপির ‘স্বভাব অনুগত’ ভোটব্যাঙ্ক, তরুণ সম্প্রদায়ের সমর্থনে ধস নামতে পারে? তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করছে গেরুয়া নেতৃত্ব। আর তাই ঝুঁকি না নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনাথের পাশাপাশি আসরে নেমেছেন খোদ অমিত শাহ। শনিবার সকাল থেকে তাঁর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে টুইটার হ্যান্ডলই ছিল বিক্ষোভ প্রশমণের চেষ্টার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। অগ্নিবীরদের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে বিজেপি বা বিজেপি জোট পরিচালিত বিভিন্ন রাজ্যের সরকারও।
প্রশাসন পরিচালনা সম্পর্কে ধারণা আছে এমন ব্যক্তিদের একটি অংশ বলছেন, সেনায় সংস্কার, তার প্রয়োগ এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এমনিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বিশেষ কিছু করার নেই। পুরোটাই দেখার কথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের। কিন্তু সেই সংস্কারের পথে হাঁটতে গিয়ে যে আগুন জ্বলে উঠেছে, তাকে স্তিমিত করতে আসরে নামতেই হচ্ছে শাহি-মন্ত্রককে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছে, আধাসেনা বা তাদের আওতায় থাকা সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাবেন অগ্নিবীররা। একই সঙ্গে, বিজেপি বা বিজেপি জোট শাসিত বিভিন্ন রাজ্যও তাদের হাতে থাকা সশস্ত্র বাহিনীতে অগ্নিবীরদের নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিতে শুরু করেথে। একই কথা প্রযোজ্য কেন্দ্রের অন্যান্য মন্ত্রকের ক্ষেত্রেও। জাহাজ এবং ক্রীড়া মন্ত্রক শনিবার সন্ধ্যায় আলাদা ভাবে জানিয়েছে, তারাও চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করছে অগ্নিবীরদের। এমনকি যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে থাকছে ‘অগ্নিপথ’, যে মন্ত্রকের সেনাবাহিনীতে ২৫ শতাংশ অগ্নিবীর চাকরি পাবেন বলে ঘোষণা করেছিল কেন্দ্র, সেই মন্ত্রক আরও কিছু বিভাগে অগ্নিবীরদের নিয়োগ করবে বলে শনিবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সংস্কারের পথে হাঁটতে গিয়ে মোদী সরকারের হোঁচট খাওয়ার দৃষ্টান্ত অবশ্য আগেও দেখা গিয়েছে। কিছু কাল আগেই নতুন কৃষি আইন এনে বড়সড় সংস্কারের দিকে এগোতে গিয়ে বড়সড় ধাক্কা খেতে হয়েছে কেন্দ্রকে। উত্তরপ্রদেশ ভোটে বিজেপির বিপুল জয় সত্ত্বেও কৃষকদের সমর্থনে যে ফাটল ধরেছে, তা টের পেয়েছেন বিজেপির ভোট বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু যোগী-মোদীর ঝড়ে তা মোটামুটি ভাবে ঢেকেচেপে রাখা গিয়েছে বলেই মনে করছেন তাঁরা। কিন্তু এ বার সেই ঝুঁকি নিতে চায় না গেরুয়া শিবির। তাই প্রথম কাজ, সেনায় সংস্কারের পথে হাঁটতে গিয়ে যে জনঅসন্তোষ প্রকাশ্যে চলে এসেছে, তাকে সামাল দেওয়া। আপাতদৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জ এ বারও বেশ কঠিন।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy