ফাইল চিত্র।
আশঙ্কা ছিল। তা সত্যি করে এসেও গেল কেন্দ্রের বার্তা।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আইএএস অফিসারদের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার উদ্যোগের মধ্যেই আইপিএস, আইএফএস-দের ক্ষেত্রেও একই রকম ব্যবস্থার আভাস-অঙ্কুর ছিল। আইএএস বদলি বিধি বদলের উদ্যোগ নিয়ে বিতর্কের সুষ্ঠু সুরাহার আগেই রাজ্যগুলিকে আইপিএস (ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস) অফিসারদেরও ডেপুটেশন বিধি সংশোধনের বার্তা দিল কেন্দ্র। তাদের বক্তব্য, বিভিন্ন রাজ্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক অফিসার না-পাঠানোয় কাজকর্ম পরিচালনায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তাই বিধি সংশোধন জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, কেন্দ্র এই দফায় রাজ্যকে জানিয়েছে, কোনও অফিসারকে ডেপুটেশনে চাওয়া হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই নির্দেশ বাস্তবায়িত করতেই হবে।
প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের মতে, আইএএস-দের মতো আইপিএস-দের ক্ষেত্রেও ‘স্ট্যান্ড রিলিজ়ড’ করার প্রস্তাব দিয়েছে কেন্দ্র। অর্থাৎ কেন্দ্র কোনও আইপিএস অফিসারকে বদলির নির্দেশ দেওয়ার পরে তিনি যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নতুন পদে যোগ না-দেন, তা হলে পুরনো পদে তাঁর বেতন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
কেন্দ্র জানিয়েছে, পুলিশ সুপার থেকে ডিজি পদমর্যাদা পর্যন্ত ৪০% পদ কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। প্রতিটি রাজ্য থেকে কেন্দ্রে অফিসার পাঠানোর কথা, অথচ কার্যক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। ডেপুটেশনে আসা অফিসারদের জন্য কেন্দ্রে ১০৭৫টি পদ রয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মাত্র ৪৪২টি পদ পূরণ হয়েছে। বাংলায় পুলিশের সিনিয়র পদ রয়েছে ১৮৮টি। রাজ্যের ‘কোটা’ অনুযায়ী কেন্দ্রের ডেপুটেশনে ৭৫ জন অফিসার পাঠানোর কথা। কিন্তু আছেন মাত্র ১২ জন। কেন্দ্রের অভিযোগ, নির্দিষ্ট সংখ্যক অফিসার না-পাঠানোয় কেন্দ্রীয় বাহিনীতে পুলিশ সুপার, আইজি, ডিআইজি পদমর্যাদার ৩১৩টি পদ ফাঁকা রয়েছে।
এই অবস্থায় কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত, ডেপুটেশনের ঘাটতি মেটাতে সংশ্লিষ্ট বিধি সংশোধন করা দরকার। তবে ডেপুটেশন নিয়ে তারা রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা করবে বলেই আশ্বাস দিয়েছে কেন্দ্র। ডেপুটেশনে অফিসার বাছাই করতে পূর্ণ ক্ষমতাও থাকবে রাজ্যের। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অফিসারদের ছেড়ে দিতে হবে সব রাজ্যকেই।
২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডার কনভয়ে হামলার ঘটনার পরে সার্ভিস রুলের ৬(১) ধারা উল্লেখ করে রাজ্যের তিন আইপিএস অফিসারকে ডেপুটেশনে চেয়েছিল কেন্দ্র। প্রশাসনিক ব্যাখ্যায়, সর্বভারতীয় ক্যাডার অফিসারদের ডেপুটেশন নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ বাধলে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তই মেনে নিতে হবে রাজ্যকে। তবু রাজ্যে থাকা অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব রাজ্যেরই— এই তত্ত্বের ভিত্তিতে তাঁদের ছাড়েনি বাংলা। তাই এ বার বিধি সংশোধন করে নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতেই নিতে চাইছে কেন্দ্র। প্রবীণ আইপিএস অফিসারদের অনেকেই জানাচ্ছেন, অফিসার নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রের সাম্প্রতিক উদ্যোগে রাজ্যের ভূমিকা খর্ব হবে। বিভ্রান্তি তৈরি হবে অফিসারদের দায়বদ্ধতা নিয়েও।
বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, “অতীতে রাজীব কুমারকে বা পরবর্তী কালে নড্ডার উপরে হামলার ঘটনায় তিন আইপিএস-কে তলব করেছিল কেন্দ্র। কিন্তু রাজ্য সরকার না-ছাড়ায় তাঁরা যেতে পারেননি। রাজ্য যাতে সর্বভারতীয় অফিসারদের অহেতুক আটকে রাখতে না-পারে, তাই এই সংশোধনের প্রয়োজন হচ্ছে।”
আইএএস ক্যাডার বিধি সংশোধন নিয়ে বিতর্কের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ব্যাখ্যা, আইএএস-দের নিয়োগ করে কেন্দ্রই। তাঁরা বিভিন্ন রাজ্য ক্যাডারে কাজ করেন। আবার ডেপুটেশনে কেন্দ্রের কাজও করতে হয় তাঁদের। কেন্দ্রে ৪০% পদ ডেপুটেশনের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। সেখানে সব রাজ্য থেকেই অফিসারদের প্রতিনিধিত্ব থাকার কথা। ২০১১ সালে কেন্দ্রের এই ধরনের পদে ৩০৯ জন অফিসার ছিলেন, এখন আছেন ২২৩ জন। শতাংশের বিচারে এই সময়সীমায় তা ২৫% থেকে কমে হয়েছে ১৮%। ডেপুটি সেক্রেটারি বা ডিরেক্টর পর্যায়ে ২০১৪ সালে ছিল ৬২১টি পদ। সংখ্যাটা বেড়ে ২০২১ সালে হয়েছে ১১৩০। কিন্তু ওই সব পদে ডেপুটেশনে থাকা অফিসারের সংখ্যা এই সময়ের মধ্যে ১১৭ থেকে কমে হয়েছে ১১৪। তাই ক্যাডার বিধি সংশোধন করা দরকার।
প্রবীণ আধিকারিকদের ব্যাখ্যা, স্বাধীনতার পর থেকে এখনও পর্যন্ত আইএএস, আইপিএস এবং ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস (আইএফএস) সর্বভারতীয় পেশা হিসেবে গ্রাহ্য। এই সব পেশাতেই ‘ফিল্ড পোস্টিং’ হয়, একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে কাজ করতে হয়। বহু দিন ধরে অন্য কয়েকটি পেশাকে সর্বভারতীয় তকমা দেওয়ার চর্চা চললেও এখনও তা কার্যকর হয়নি। কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই জায়গাতেই কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রাক্তন আইএএস এবং এখন রাজ্যসভার তৃণমূল সদস্য জহর সরকার বলেন, “এ ভাবে রাজ্যের উপরে চাপ বাড়ানো অনৈতিক। এক জন আমলার দায়বদ্ধতা থাকে রাজ্যের প্রতি। কেন্দ্রে থাকলে সেখানকার রীতিনীতি তিনি মেনে চলেন। কেন্দ্রের এই সরকার এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে একটা ভয় থাকবে প্রত্যেকের মধ্যে। কারণ, যখন-তখন কেন্দ্র ডেকে নিয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে শাস্তিমূলক বদলির আতঙ্কও কাজ করছে। এর বিরুদ্ধে আইনি পথে হাঁটা উচিত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy