ভারতের মহাকাশ গবেষণায় বিখ্যাতদের পরবর্তী প্রজন্মের আড্ডা। বাম দিক থেকে সুমন্ত্র দাস, (মেঘনাদ সাহার নাতি) নওয়াল কিশোর মিত্র, (সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাতি), মালবিকা বসু (সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাতনি), রাধিকা রামনাথ, (সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখরের ভাগ্নি) এবং সন্দীপ কুমার চক্রবর্তী, আই সি এস পি অধিকর্তা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
এ গল্পের সূত্রধর বিজ্ঞান। গল্প চলছে তিন ভারতীয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, এস চন্দ্রশেখর এবং তাঁদের সঙ্গে জুড়ে থাকা আরও সব তাবড় নাম নিয়ে। কখনও উঠে আসছে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী রিচার্ড ফিনম্যানের নাম, কখনও ব্রিটিশ পদার্থবিদ আর্থার এডিংটনের কাহিনি। আড্ডায় বসেছেন জগৎ-বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের উত্তরসূরিরা। বলা যায় ‘রত্ন-জাত’রা। বুধবার আলোচনাচক্রটির আয়োজন করেছিল কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স’ (আইসিএসপি)। নাম রাখা হয়েছিল ‘ডিসেনডেন্টস অব দ্য জায়ান্টস’। গল্প-আড্ডায় কখনও উঠে এলে সত্যেন্দ্রনাথের মিষ্টি-প্রীতি, কখনও আবার কথা হল মেঘনাদ সাহার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বময় প্রতিযোগিতা নিয়ে। জানা গেল চন্দ্রশেখরের ভালবাসার ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজ়িক বাখ।
যাঁর ‘থিয়োরি অব আয়োনাইজেশন’ সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে, জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রথম সারিতে যাঁর নাম উচ্চারিত হয়, ব্যক্তিগত জীবনে কেমন ছিলেন সেই মানুষটা? সেই ছাপোষা বাঙালি গৃহকর্তাটি, অর্থাৎ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার গল্প শোনালেন তাঁর মেয়ের ঘরের নাতি সুমন্ত্র দাস। উপস্থিত ছিলেন, বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পৌত্রী মালবিকা বসু এবং দৌহিত্র নওয়াল কিশোর মিত্র। আর ছিলেন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী এস চন্দ্রশেখরের ছোট ভাইয়ের মেয়ে রাধিকা রামনাথ। জেঠুর একাধিক বক্তৃতা শুনেছেন তিনি, জেঠুর হাত থেকেই জীবনের প্রথম কম্পিউটারটি উপহার পেয়েছেন। পরবর্তী কালে রাধিকা বই লেখেন, ‘এস চন্দ্রশেখর ম্যান অব সায়েন্স’।
মালবিকা বর্তমানে ‘টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি ডাবলিন’-এর ‘স্কুল অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং’-এ অধ্যাপনা করেন। জানালেন, মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু সহপাঠী ছিলেন। ঘনিষ্ঠ ছিলেন দু’জনে, তবে একই সঙ্গে বেশ একটু প্রতিযোগিতাও ছিল। আবার একে অন্যের কাজ সম্পর্কে আলোচনাও করতেন সময় বিশেষে। তবে দু’জনের বেড়ে ওঠা দুই পরিবেশে। মেঘনাদ সাহার নাতি, আইআইসিবি-র অবসরপ্রাপ্ত নিউরোবায়োলজিস্ট সুমন্ত্র জানালেন, খুব গরিব পরিবারের ছেলে ছিলেন দাদু। জীবন জুড়ে তাই শুধু লড়াই। অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা, তার মধ্যে স্বদেশী আন্দোলন করায় স্কুল থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। বাইবেল পড়ে মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। তবে ধর্মচর্চা নয়, উৎসাহ ছিল বাইবেল প্রতিযোগিতা নিয়ে। প্রতিযোগিতায় জিতলে নগদ-পুরস্কার মিলত। টানাটানির সংসারে দু’পয়সা আয় হত। পরবর্তী কালে অবশ্য ইলাহাবাদে বড় বাড়ি করেছিলেন তিনি। গবেষণার পাশাপাশি সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাজ নিয়ে এতটাই মেতে থাকতেন যে হার্টের অসুখ ধরা পড়ার পরেও ঠিকমতো ডাক্তার দেখাননি। প্ল্যানিং কমিশনের অফিসে যাওয়ার পথে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬২ বছর বয়সে মারা যান।
সত্যেন্দ্রনাথের সম্পর্কে আবার শোনা গেল, তিনি মানিব্যাগ প্রায় উপুড় করে দানধ্যান করতেন। বাড়িতে বলতেন, ‘‘ও আতর এনে দেবে, তাই টাকা দিয়েছি।’’ সে কথা যে বিন্দুমাত্র সত্যি নয়, সবাই জানতেন। তাঁর বাড়ি ছিল অবারিত দ্বার। আতর অবশ্য সত্যিই খুব ভালবাসতেন সত্যেন্দ্রনাথ। ফরাসি সুগন্ধী খুব প্রিয় ছিল। পরের দিকে নিজেই আতর ও অ্যালকোহল মিশিয়ে বাড়িতে সুগন্ধী তৈরি করতেন।
নওয়াল বলেন, ‘‘খেতে খুব ভালবাসতেন দাদু। কিন্তু তার থেকেও বেশি ভালবাসতেন খাওয়াতে। বাড়িতে মিষ্টি আসত শিমলা পাড়ার দোকান থেকে। সে মিষ্টি মানুষে খেত না, বিড়ালের পেটে যেত। বাড়িতে মাছ আসত। ভাল মাছ না এলে দাদুর রাগ হত খুব। কিন্তু সে-ও মানুষের পেটে যেত না। যেত বিড়ালের পেটে।’’ তিনি জানান, দাদু ভালবাসতেন
মাটন। দাদুর জন্য বাজার করে আনতেন তিনি। যে সে রান্না হত না। তাতেও রীতিমতো গবেষণা চলত। —‘‘দাদু বলতেন, জানিস এর নাম কী? জার্মানিতে একে বলে ‘স্নিৎজ়েল
অব নুডলস।’’
যিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পথিকৃত, যাঁর হাত ধরে তৈরি হয়েছে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স, সেই সত্যেন্দ্রনাথ বসুই আবার রীতিমতো সঙ্গীতচর্চা করতেন। চন্দ্রশেখরও তাই। তাঁর খুব কাছের ছিল বাখ-এর মিউজ়িক। সফ্টওয়্যার বিশেষজ্ঞ রাধিকা জানান, অঙ্কে খুব ভাল ছিলেন চন্দ্রশেখর। ওটা তাঁর জন্য খুব সহজ বিষয় হয়ে যাবে, তাই তাঁর মা নির্দেশ দিয়েছিলেন, পদার্থবিদ্যা পড়তে হবে। একই সঙ্গে পালা করে চলত, ভায়োলিন ও বীণা-শিক্ষা। এ নিয়েও বেশ কড়া শাসনে থাকতে হত। দাদুর কথা বলতে বলতে আবেগে ভেসে যান রাধিকা।
মালবিকা মাইক টেনে নেন। বোঝা যায় দাদুর কথা বলতে গিয়ে তিনিও বেশ উচ্ছ্বসিত। বলেন, ‘‘একটা গল্প মনে পড়ে গেল। মা বলেছিল। পদার্থবিদ্যার একটি বিষয় নিয়ে দাদু মাদাম কুরির কাছে পড়তে গিয়েছিলেন। কুরি বলেছিলেন, কয়েক মাস পরে এসো, তোমায় ফরাসি শেখাব। দাদু তখনই ফরাসি জানতেন। কিন্তু মাদাম কুরিকে না করতে পারেননি। তাঁর কাছে গিয়ে ফের ফরাসি পড়েছিলেন।’’ এমন কাণ্ড যেমন আছে, আবার বাড়ির গোয়ালার পিছনে লাঠি নিয়ে ছোটাও আছে। সে দুধে জল মেশাতো। সত্যেন্দ্রনাথ দুধে ল্যাকটোজ় মেপে লাঠি নিয়ে তাকে তাড়া করেছিলেন।
বিজ্ঞান ও তার পুত্রদের গল্পগাথায় মোরা এক দিন। আয়োজক আইসিএসপি-র অধিকর্তা সন্দীপ কুমার চক্রবর্তী নিজে চন্দ্রশেখরের ছাত্র ছিলেন। তাঁর মুখেও ঘুরেফিরে এল শিক্ষক-স্মৃতি। জানালেন, চন্দ্রশেখরের কোনও গবেষণাপত্রে যদি এতটুকু ভুল ধরা হত, সেটা যদি তিরিশ বছর আগের কোনও কাজও হয়, তখনই তা বার করে সংশোধন করতেন। কাজের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ছিল এতটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy