অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্তন ক্যানসার বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা। ক্যানসার নিরাময় করতে হলে রেডিয়োথেরাপি ও কেমোথেরাপি দিতেই হবে, যা গর্ভস্থ সন্তানের পক্ষে চরম ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। গর্ভপাতের আশঙ্কাও বেশি। এমন অবস্থায় বছর ৩৮-এর মহিলাকে গর্ভপাত করানোরই নিদান দিয়েছিলেন অনেক চিকিৎসক। চিকিৎসকদের এমন কথায় ভেঙে পড়লেও হাল ছাড়েননি তিনি। গর্ভস্থ সন্তানের সুস্থ ভাবে জন্ম দেওয়া এবং একই সঙ্গে ক্যানসারের চিকিৎসা চালানোর আর্জি নিয়ে মিজ়োরাম থেকে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁর আকুতি শুনে হার মানেন চিকিৎসকেরাও। কলকাতার হাসপাতালে অভিজ্ঞ অঙ্কোলজিস্টদের সহযোগিতায় স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা তো চলছেই, সেই সঙ্গে সুস্থ কন্যাসন্তানের জন্মও দিয়েছেন মহিলা।
কলকাতার বাইপাসের ধারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ওই মহিলার চিকিৎসা চলছে। সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট শুভদীপ চক্রবর্তী, চিকিৎসক তাপস কর, কনসালট্যান্ট মেডিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট পিএন মহাপাত্র এবং স্ত্রীরোগ চিকিৎসক রামনা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই মহিলার চিকিৎসার দায়িত্বে রয়েছেন।
অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্তন ক্যানসার হলে তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘প্রেগন্যান্সি অ্যাসোসিয়েটেড ব্রেস্ট ক্যানসার’ (পিএবিসি),যা খুবই বিরল ঘটনা। প্রতি ১০০০ জন অন্তঃসত্ত্বার মধ্যে ০.৩ শতাংশের হয়। এই ধরনের স্তন ক্যানসার খুবই বিপজ্জনক। যে হেতু গর্ভাবস্থায় হরমোনের তারতম্য অনবরত হতে থাকে, তাই ক্যানসার ধরাও পড়ে দেরিতে। খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়তে পারে শরীরে।
আরও পড়ুন:
অঙ্কোলজিস্ট শুভদীপ চক্রবর্তী আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “মহিলার যখন গর্ভাবস্থার ১৭ সপ্তাহ চলছে, তখন বাঁ দিকের স্তনে ৭*৫ সেন্টিমিটারের একটি মাংসপিণ্ড গজিয়ে ওঠে। বায়োপ্সি করে দেখা যায়, সেটি ‘টিউবিউলার অ্যাডেনোমা’ অর্থাৎ এক ধরনের পলিপ, যা ক্যানসার নয়। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেখানে কোষের অনিয়মিত বিভাজন ঘটে তা ক্যানসারের রূপ নেয়। স্থানীয় চিকিৎসকেরা ধরতে পারেননি। মহিলা যখন আমাদের কাছে আসেন, তখন অনেকটাই সময় পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এর পরেও তাঁর ক্যানসারের চিকিৎসা সফল ভাবেই হয়।” চিকিৎসকের কথায়, স্তনে ক্যানসার কোষ খুব দ্রুত ছড়াচ্ছিল। তাই কেমোথেরাপি দিতেই হত। কিন্তু ভয়ও ছিল যে, কেমোথেরাপি চলার সময় গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। সাধারণত, এমন হলে অনেক চিকিৎসকই গর্ভপাত করিয়ে নিতে বলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। কারণ, মহিলা সন্তানের জন্ম দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসের মধ্যে ভ্রূণের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি হয়ে যায়। মহিলার যখন ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু হয়, তখন তৃতীয় ট্রাইমেস্টার শুরু হয়ে গিয়েছে। এমন অবস্থায় কেমোথেরাপি হলে সন্তানের বৃদ্ধি থমকে যেতে পারে, অথবা কোনও দুরারোগ্য ব্যধি নিয়ে জন্মাতে পারে সন্তান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা নিও অ্যাডজুভেন্ট কেমোথেরাপি (এনএসিটি) দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে ৮ সাইকেলে কেমো দেওয়ার কথা ভাবা হয়। তবে ৭ সাইকেলের পরেই মহিলার প্রসব করানো হয়। তত দিন ক্যানসার কোষের বিভাজন বন্ধ হয়েছে। ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও দূর হয়েছে।
শুভদীপ জানাচ্ছেন, মহিলা সুস্থ কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন, যার ওজন ২ কেজি ৮০০ গ্রাম। সদ্যোজাতের শরীরে কোনও রকম অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি। মহিলাও অনেকটাই সুস্থ। তবে তাঁর রেডিয়েশন থেরাপি এখনও চলছে।
বংশানুক্রমে ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে, পরবর্তী প্রজন্মেরও তা হতে পারে বলে দেখা গিয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। কিন্তু মিজ়োরামে ওই মহিলার বংশে ক্যানসারের ইতিহাস নেই। তবে ‘হোমোলোগাস রিকম্বিন্যান্ট জিন প্যানেল’ টেস্ট করে দেখা গিয়েছে ক্যানসার ঘটাতে পারে এমন জিন রয়েছে ওই মহিলার শরীরে। সাধারণত বিআরসিএ১ ও বিআরসিএ২ জিনের মিউটেশন (জিনের রাসায়নিক বদল) হলে পিএবিসি হওয়ার আশঙ্কা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। চিকিৎসকদের পরামর্শ, স্তনে কোনও রকম মাংসপিণ্ড দেখলে অথবা স্তনবৃন্ত থেকে কোনও প্রকার ক্ষরণ, স্তনের আকার বদল হলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি এর পরীক্ষা হবে, নিরাময়ও ততই তাড়াতাড়ি হবে।