হার্টের অসুখ, কিডনির অসুখ, অথবা ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসের মতো রোগগুলি আজকাল যে কোনও বয়সের মানুষের মধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। আর তাতেই নয়া সংযোজন, ভুলে যাওয়ার রোগ। আগে যা ‘বৃদ্ধদের রোগ’ বলে চিহ্নিত করা যেত, এখন তা সহজে আর করা যায় না।
কমবয়সিদের মধ্যে ভুলে যাওয়ার সমস্যা বেড়েছে। তবে এই ভুলে যাওয়া কি ডিমেনশিয়ার প্রাক্-লক্ষণ? উত্তর খুঁজতেই যোগাযোগ করা হল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সেস, কলকাতার মনোরোগ চিকিৎসক সৌভিক চক্রবর্তীর সঙ্গে।
আরও পড়ুন:
চিকিৎসকের কথায়, ''এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আগে বুঝতে হবে ডিমেনশিয়া রোগটিকে। মস্তিষ্কের মধ্যে বেশ কিছু প্রোটিন রয়েছে, যেগুলির বিরুদ্ধে শরীর নিজেই কিছু অ্যান্টিবডি তৈরি করে। তার ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলি (যাকে আমরা ‘নিউরন’ বলি) ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে। মস্তিষ্কের যা যা কাজ, তার মধ্যে অন্যতম, কগনিশন বা চিন্তা করার শক্তি, মনে রাখার শক্তি। সেগুলি নষ্ট হতে থাকে। ডিমেনশিয়ার রোগীরা পুরনো তথ্য মনে রাখতে পারেন। কিন্তু নতুন তথ্য মস্তিষ্কে বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয় না। কী খেয়েছেন, কখন খেয়েছেন, ঘরের মধ্যে বাথরুম কোথায়, এই রকম দৈনন্দিন তথ্য ভুলে যেতে থাকেন। অ্যান্টিবডি ছাড়াও ডিমেনশিয়ার আরও একটি কারণ রয়েছে। মস্তিষ্কে অনেক দিন ধরে রক্ত সঞ্চালন না হলে কোষগুলি নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। যেটা ব্লাড প্রেসার অথবা ব্লাড সুগার থাকলে বেশি দেখা যায়।''

ছবি: সংগৃহীত।
চিকিৎসক জানালেন, ডিমেনশিয়া মূলত ৬০ বছরের আশপাশে শুরু হয়। কমবয়সিদের মধ্যে এই রোগ খুবই বিরল। জিনগত কারণে হতে পারে কম বয়সে। তবে ডিমেনশিয়া বা অ্যালঝাইমার্সের মতো রোগ মূলত বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত। কমবয়সিদের মধ্যে ভুলে যাওয়ার সমস্যার বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে:
মানসিক চাপ: অত্যধিক মানসিক চাপ, উদ্বেগ (যেমন পরীক্ষার চাপ, চাকরির চাপ, অর্থনৈতিক চাপ) মানুষের স্মৃতি ও মনোযোগে প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘ দিন ধরে মানসিক চাপে থাকার ফলে ভুলে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ঘুমের অভাব: পর্যাপ্ত বা গভীর ঘুম না হলেও স্মৃতিশক্তি কমে যেতে পারে। ঘুমের ক্ষেত্রে জীবনযাপন নানা ভাবে প্রভাব ফেলে। ফোন বা কম্পিউটারের প্রতি আসক্তি, এবং অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণেও ঘুমের অভাব হতে পারে।
আরও পড়ুন:
খাদ্যাভ্যাস: নতুন প্রজন্মের খাদ্যতালিকায় পুষ্টিকর খাবারের উপস্থিতি বেশ কমে গিয়েছে। ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যেতে পারে। বিশেষ করে ভিটামিন, মিনারেল বা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের অভাব মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
মানসিক রোগ: অবসাদ, বিষণ্ণতা, অ্যাংজ়াইটি ডিজ়অর্ডার বা এডিএইচডি (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজ়অর্ডার)-র মতো মানসিক রোগ স্মৃতিশক্তির উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
শারীরিক সমস্যা: কিছু রোগ যেমন, হরমোন ক্ষরণে ভারসাম্যের অভাব, থাইরয়েডের সমস্যা বা স্নায়ুর অসুখ (যেমন ট্রমা) কমবয়সিদের মধ্যে ভুলে যাওয়ার সমস্যা বাড়াতে পারে।

অতিরিক্ত স্মার্টফোন বা ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহারের ফলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। ছবি: সংগৃহীত।
ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার: অতিরিক্ত স্মার্টফোন বা ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহারও মস্তিষ্কের একাগ্রতা কমাতে পারে, ফলে মানুষের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
মনোযোগের অভাব: ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের কারণেই মনঃসংযোগের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে অল্পবয়সিদের মধ্যে। মনে রাখার প্রয়োজনীয়তা হারাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। একে বলে ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট’।
ডিমেনশিয়া সাধারণত বয়স বাড়ার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি রোগ। কমবয়সিদের মধ্যেও যদি ভুলে যাওয়ার সমস্যা বেশি দেখা দেয়, তা সরাসরি ডিমেনশিয়া নয়। তবে, যদি ভুলে যাওয়ার সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হয়, তা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তবে এই ধরনের রোগ থেকে স্বাভাবিক বা ঘরোয়া উপায়েও মুক্তি পাওয়া যায়।
চিকিৎসকের মতে, মনের একাগ্রতা বাড়াতে পারে, এমন কিছুর অনুশীলন শুরু করা উচিত। যেগুলির মধ্যে অন্যতম হল ধ্যান। এ ছাড়া ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার কমিয়ে বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে। খেলাধুলো করাও দরকার। স্ট্রেস বা মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার। স্ক্রিন টাইম কমিয়ে দিলে বাকি উপসর্গ নিজে থেকেই অনেকটা কমে যাবে বলে চিকিৎসকের বক্তব্য।