Advertisement
E-Paper

মহাকাশে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন না সুনীতারা! তবে অত শীর্ণ হলেন কেন? পুষ্টির ঘাটতি এড়াতে কী খান তাঁরা?

মহাশূন্যে মহাকাশচারীদের জীবন কেমন হয়? মহাকাশযানে তাঁরা কী ভাবে থাকেন? কী খাওয়াদাওয়া করেন? সুনীতা উইলিয়ামস এত দিন ধরে মহাকাশে রয়েছেন, তাঁর চেহারাই বা ও রকম হয়ে গেল কেন? পুষ্টির অভাব ঘটছে কি মহাকাশে?

এত শীর্ণ হয়ে গেলেন কেন সুনীতা? পৃথিবীর কক্ষে বসে কী খান মহাকাশচারীরা?

এত শীর্ণ হয়ে গেলেন কেন সুনীতা? পৃথিবীর কক্ষে বসে কী খান মহাকাশচারীরা? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

দেবজয় দেব

দেবজয় দেব

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:০৩
Share
Save

মহাকাশে বসে কিসের অভাব সবচেয়ে বেশি বোধ করছেন সুনীতা উইলিয়ামস? সম্প্রতি তার উত্তর দিয়েছেন ভারতীয় বংশদ্ভূত মহাকাশচারী। জানিয়েছেন, বাড়ির খাবারই টানছে বেশি। মহাকাশে গিয়ে যাঁরা দিনের পর দিন থাকেন, তাঁরা কী খান? সুনীতার যে সাম্প্রতিক ছবি দেখা গিয়েছে, ছবিটা ও রকম এল কেন? ছবিতে তাঁকে এত রোগা ও ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন?

সবের আগে যে কথা মনে হয়, তা হল ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া না হওয়া। এবং তা তো ঠিকই। নিজের ঘরের মতো তো হয় না। দিনের পর দিন বেশ কষ্ট করেই যে থাকতে হয় মহাকাশযানে। মূলত কী খাবার খেলে মহাকাশচারীদের পুষ্টির ঘাটতি হবে না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা, গবেষণা চলে। কিন্তু সুনীতার সাম্প্রতিক ছবি অনেকের মনে প্রশ্ন তুলছে, তবে কি ভাল নেই তিনি?

পৃথিবীর মতো পাত পেড়ে খাওয়ার ব্যবস্থা তো নেই মহাকাশে, সব রকম খাবার খাওয়াও সম্ভব নয়। তা হলে দীর্ঘ দিন ধরে মহাকাশে শূন্য মাধ্যাকর্ষণে থাকার কারণে কি সঠিক পুষ্টি পাচ্ছেন না সুনীতারা?

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। ছবি সূত্র: নাসা।

ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক তেমন নয়। মহাকাশে খাবার বাছাই করতে হয় মাইক্রোগ্র্যাভিটির কথা মাথায় রেখে। এমন কিছু মহাকাশে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ, যা থেকে বিপদ ঘটতে পারে। দীর্ঘ দিন মহাকাশে থাকার জন্য হালকা, সুস্বাদু, পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হয়। খাবার যাতে দ্রুত নষ্ট না হয়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। এমন খাবার, যা মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে থাকা মহাকাশচারীদের দ্রুত হজম হবে এবং দৈনিক ক্যালোরির চাহিদাও মিটবে। এমনিও মহাশূন্যে থাকাকালীন যে হেতু ওজন কমে যায়, তাই উচ্চ ক্যালোরির খাবারই খেতে হয়। সুনীতারাও যাতে তেমন খাবার পান, সে দিকেই নজর রাখা হচ্ছে। আর এখন নিয়ম অনেকটাই বদলেছে। নাসার অ্যাপোলো মিশন থেকেই দেখা গিয়েছে, মহাকাশচারীদের পছন্দের খাবারই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কোরিয়ার এক মহাকাশচারী স্পেস স্টেশনে যাওয়ার সময়ে তাঁর দেশের ঐতিহ্যবাহী পদ কিমচি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁকে নাকি সেটাই দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন দেশের মহাকাশচারীদের কথা মাথায় রেখে তাই এখন খাওয়াদাওয়াতেও বৈচিত্র আনার কথা ভাবা হচ্ছে। ভেবে দেখুন, কোনও বাঙালি মহাকাশচারী যদি কখনও মহাশূন্যে যাওয়ার সুযোগ পান, তা হলে কি তিনি আলুর দম, বেগুনভাজা বা মিষ্টি দই নিয়ে যেতে পারবেন? সেটা হয়তো সময়ই বলবে।

মহাকাশে কী খান মহাকাশচারীরা?

মহাকাশে কী খান মহাকাশচারীরা? ফাইল চিত্র।

সুনীতার চেহারা ভাঙছে তার কারণ হল, দীর্ঘ সময়ে একটানা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের বাইরে থাকায় তাঁর ওজন কমছে, প্রভাব পড়ছে রক্তচাপে। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উপরে পৃথিবীর কক্ষপথে পাক মেরে চলা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের শূন্য মাধ্যাকর্ষণে দিনের পর দিন থেকে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার কাজ কেবল কঠিনই নয়, কঠিনতম বললেও ভুল হবে না। মাইক্রোগ্র্যাভিটি বা শূন্য মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব একজনের শরীরকে কতটা নাস্তানাবুদ করতে পারে, তা কেবল মহাকাশ স্টেশনে থাকা একজন মহাকাশচারীই বলতে পারবেন। মাইক্রোগ্র্যাভিটি শরীরের মধ্যস্থ তরল ও রক্তচাপের উপর হস্তক্ষেপ করে প্রতিনিয়ত। কমতে থাকে ওজন। তরল জমা হতে থাকে মস্তিষ্কে, দুর্বল হয়ে পড়ে রোগ প্রতিরোধ শক্তি। সেই সঙ্গে মহাজাগতিক বিকিরণের ঝাপটা তো আছেই। সব সয়ে মহাকাশ স্টেশনে সাত দিন কাটানোই বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানে সুনীতা উইলিয়ামস এবং তাঁর সতীর্থ বুচ উইলমোর ছ’মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্দি রয়েছেন মহাকাশ স্টেশনে।

সুনীতাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল গত বছর জুন মাসে। মহাকাশযান বোয়িং সিএসটি-১০০ স্টারলাইনার ক্যাপসুল দুই মহাকাশচারীকে নিয়ে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের উদ্দেশে রওনা দেয় গত বছর ৫ জুন। শুরুতে কথা ছিল, কাজ শেষ হয়ে গেলে ৮ দিনের মাথাতেই ফিরবেন সুনীতারা। কিন্তু হঠাৎই মহাকাশযানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। শোনা যায়, হিলিয়াম লিকেজ হচ্ছে রকেট থেকে। আরও নানা যান্ত্রিক গোলযোগও ধরা পড়ে। রকেটের পাঁচটি ‘ম্যানুভরিং থ্রাস্টার’ খারাপ হয়ে যায়, সমস্যা দেখা দেয় একটি ধীর গতির ‘প্রপেল্যান্ট ভালভ্’-এও। সব মিলিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে সুনীতাদের ফেরা। মহাকাশ স্টেশনেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্দি হয়ে পড়েন তাঁরা। আর তার পরেই শুরু হয় লড়াই। প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার কাজটা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারেন না। আর সেখানেই জরুরি হয়ে পড়ে প্রশিক্ষণ, যা সুনীতাদের মতো মহাকাশচারীদের দেওয়া হয়। সে পথও বড় কঠিন। ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) অন্তত এক বছর ধরে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা ও স্ক্রিনিং টেস্ট করে সেই মহাকাশচারীদেরই বাছেন, যাঁরা অভিজ্ঞ ও যে কোনও বিপদসঙ্কুল পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে ঋজু থাকার ক্ষমতা রাখেন।

কেবল শারীরিক সুস্থতার নানা পরীক্ষা হয় তা-ই নয়, ব্যক্তিত্ব, সহনশীলতা, সংযম, মানসিক দৃঢ়তা, বুদ্ধিমত্তা— সব কিছুই দেখে নেওয়া হয় পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। সেই সঙ্গেই দেখে নেওয়া হয় রোগের পূর্ব ইতিহাস। যদি স্নায়বিক রোগের পূর্ব ইতিহাস থাকে অথবা ক্রনিক রোগ থাকে, তা হলে মহাকাশ স্টেশনে গিয়ে দিন কয়েক কাটিয়ে আসার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। এরও কারণ আছে। পৃথিবীর কাছের কক্ষপথে (লো-আর্থ অরবিট) থাকা মহাকাশ স্টেশনকে মহাজাগতিক রশ্মি, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ঝাপটা সইতে হয়। এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শরীরের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। তা ছাড়া, স্পেস স্টেশনে দিনের পর দিন থাকার কারণে পেশির দুর্বলতা দেখা দেয় মহাকাশচারীদের। ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কাও থাকে। তাই শরীর দুর্বল হলে বা কোনও অসুখবিসুখ থাকলে পরিণতি বিপজ্জনকও হতে পারে।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে শূন্য মাধ্যাকর্ষণে দিনের পর দিন কাটাতে হয় মহাকাশচারীদের।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে শূন্য মাধ্যাকর্ষণে দিনের পর দিন কাটাতে হয় মহাকাশচারীদের। ফাইল চিত্র।

২০০০ সালে সুনীতাদের মতোই এমন নজির গড়েছিলেন আরও দু’জন নভশ্চর। সেই প্রথম মহাকাশ স্টেশনে কয়েক মাস থেকে গবেষণা চালানোর জন্য রওনা দিয়েছিলেন তিন মহাকাশচারী। দু’জন রুশ, এক জন মার্কিন। ইউরি গিদজেন্‌কো, সের্গেই ক্রিকালেভ ও বিল শেফার্ড। তাঁরাই প্রথম মহাকাশে গিয়ে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন। আর এখন সেই রেকর্ড গড়ছেন সুনীতা উইলিয়ামসরা।

মহাশূন্যে দীর্ঘ দিন থাকার কারণে আরও যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় মহাকাশচারীদের, তা হল মানসিক সমস্যা। পরিবার ও সমাজ থেকে দীর্ঘ দিন বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে মনের উপর চাপ তো পড়েই, মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতিও হয় অনেক ক্ষেত্রে। মহাকাশচারীদের এই ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য বছরের পর বছর বিশেষ প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। দেখবেন, সুনীতা নানা ভিডিয়ো পোস্টে হাসিমুখেই বলছেন, যে তিনি দিব্যি ভাল আছেন। শরীর ভাঙলেও মন ঠিক আছে। কারণ, তিনি পেশাদার। যে কোনও প্রতিকূল অবস্থাতেও মানিয়ে নিতে শিখে গিয়েছেন।

ঘুমের সমস্যাও খুবই ভোগায় মহাকাশচারীদের। আমাদের মতো নরম বিছানায় শুয়ে নিশ্চিন্তের টানা ঘুম তো আর সম্ভব নয়। কারণ, সেখানেও জটিলতা আছে। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র হওয়ার সুবাদে মাইক্রোগ্র্যাভিটি নিয়ে গবেষণা করছি। এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, অন্ত্রের সঙ্গে মস্তিষ্কের যোগসূত্র রয়েছে। আমরা দেখেছি, মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে মহাকাশচারীদের ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’ বা দেহের নিজস্ব ঘড়ি থাকে, বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘সার্কেডিয়ান রিদ্‌ম’। তার পরিবর্তন হয়। পৃথিবীতে এই ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু মহাকাশে তা বদলে যায়। কাজেই সেখানে কী ভাবে মহাকাশচারীদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলি নিয়মমতো চলে, সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। তার জন্যও প্রশিক্ষণ নিতে হয়।

স্পেস স্টেশনের ভিতর কাজ করছেন সুনীতা।

স্পেস স্টেশনের ভিতর কাজ করছেন সুনীতা। ছবি সূত্র: নাসা।

এমন প্রশিক্ষণ কি আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষকেও দেওয়া সম্ভব? সময় হয়তো সে দিকেও এগোচ্ছে। ‘স্পেস ট্যুরিজ়ম’ নিয়ে যা হইচই চলছে, তাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে স্পেসএক্স, ব্লু-অরিজিনের মতো সংস্থা সাধারণ মানুষজনকেও শিখিয়ে-পড়িয়ে মহাকাশে নিয়ে গিয়ে চাঁদ-তারা দেখিয়ে আনবে। তবে পৃথিবীর মধ্যে থেকে দুর্গম স্থানে ভ্রমণ আর পৃথিবীর ‘মায়া’ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়া, দুটো জিনিস কিন্তু এক নয়। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তা কতটা সহনীয় হবে, সে নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।

ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো তো মহাকাশে মানুষ নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছে বহু দিন থেকেই। ‘গগনযান’ মিশনের জন্য নভশ্চরদের বেছে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও হচ্ছে। চাঁদ ও মঙ্গলে সফল ভাবে মহাকাশযান নামিয়েছে ইসরো। এ বার তাদের লক্ষ্য নিজস্ব মহাকাশ স্টেশন বানানো। গগনযান তারই পূর্বপ্রস্তুতি মাত্র। ভারতের নিজস্ব স্পেস স্টেশনে কী ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। এই স্পেস স্টেশনটিকে নিম্ন কক্ষপথে অবস্থান করানো হবে। নাম রাখা হতে পারে ‘ভারতীয় অন্তরীক্ষ স্টেশন’। মহাকাশে ‘অ্যাস্ট্রোবায়োলজি’ এবং ‘মাইক্রোগ্র্যাভিটি’ সংক্রান্ত নানা রকম গবেষণা করা হবে এই স্পেস স্টেশনে। পৃথিবীর মতোই তার উপগ্রহ চাঁদ বসবাসযোগ্য কি না, তা নিয়েও গবেষণা চলবে স্পেস স্টেশনে। ভারতীয় মহাকাশচারীদের সেখানে পাঠানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। সে চেষ্টাও হয়তো সফল হবে আগামী দিনে।


লেখক নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পেস নিউট্রিশন নিয়ে গবেষণারত

Sunita Williams International Space Station Space News Space Nutrition

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}