উন্নত থেকে উন্নততর ওষুধ, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অস্ত্রোপচার— প্রতিনিয়ত গোটা বিশ্ব জুড়ে চিকিৎসা জগতে চলছে নানা গবেষণা। তেমনই হল রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারি, যা এখন বেশ চর্চায়। ইউরোপ-আমেরিকার মতো আমাদের দেশেও প্রবেশ করেছে রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারি। বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এই সার্জারি হচ্ছে। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি এ বার সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএম-এও রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারি শুরু হতে চলেছে।
রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারি আসলে কী?
রোবটিক সার্জারি শুনে মনে হতেই পারে রোগীর অস্ত্রোপচার করবে একজন রোবট, ডাক্তারের প্রয়োজন নেই! এই ব্যাপারে সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট এবং ব্রেস্ট সার্জন অধ্যাপক ডা. দীপ্তেন্দ্র সরকার বললেন, ‘‘রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারির অর্থ এই নয় যে রোবট সরাসরি রোগীর অপারেশন করবে। রোবটের হাত এবং চিকিৎসকের মস্তিষ্ক, দুটো মিলিয়ে যে সার্জারি হয় তাকে বলে রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারি। এই ধরনের সার্জারি যে ঘরে হয়, সেখানে একটা কনসোল থাকে, তার মধ্যে সার্জন বসেন। সেখান থেকে কিছুটা দূরে রোগী অচেতন অবস্থায় থাকেন। কনসোলে মনিটরের মধ্য দিয়ে সার্জন রোগীর সার্জারির স্থানটি দেখতে পান। তাঁর শরীরে যে অংশে অস্ত্রোপচার করা হবে সেখানে রোবটিক পোর্টগুলো ডকিং করা হয়, ঠিক যেমন ল্যাপরোস্কপি করার সময়ে ল্যাপরোস্কপিক পোর্ট শরীরে প্রবেশ করানো হয়। ওই পোর্টগুলোর মধ্য দিয়ে রোবটিক হ্যান্ড সার্জারির জায়গায় কাজ করে। এ দিকে কনসোলের মনিটরে চোখ রেখে স্টিকের মাধ্যমে ডাক্তার সেই রোবটিক হাত অর্থাৎ কাটাছেঁড়া নিয়ন্ত্রণ করেন। সার্জনের আঙুল যে ভাবে নড়েচড়ে তা সেনসিং হয়ে চলে যাচ্ছে রোবটিক হাতে। ডাক্তার দেখছেন, তিনিই অপারেশন করছেন কিন্তু তাঁর হাতের বদলে রোবটের হাত কাজ করছে, অর্থাৎ রোবটের হাত ডাক্তারের ব্রেন!’’
রোবটের হাত আর চিকিৎসকের হাতের মধ্যে তফাৎ কোথায়?
সব ধরনের অস্ত্রোপচারের জন্য না হলেও বেশ কিছু জটিল ক্ষেত্রে রোবটিক হাত যথেষ্ট কার্যকর। চিকিৎসকরা মনে করেন, এতে ঝুঁকি কম এবং বেশ কিছু সুবিধেও রয়েছে। যেমন রেঞ্জ অব মুভমেন্ট— একজন সার্জন যখন নিজের হাতে অস্ত্রোপচার করেন, তখন তাঁর আঙুল সামনে, পিছনে নাড়াতে পারবেন, বড়জোর একটু তেরচা করতে পারবেন। কিন্তু রোবটের হাতের আঙুল সেভেন ডিগ্রি অব মুভমেন্টে চলে। ‘‘বিশেষ করে সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে রোবটিক হাত খুব উপযোগী, যেখানে আমাদের আঙুল পৌঁছনো বা ল্যাপরোস্কপি করা বেশ কঠিন। রোবটিক হাতের আঙুলে একাধিক জয়েন্ট থাকায় অনেক দিকে ঘোরানো সম্ভব। এটা মানুষের হাত পারবে না,’’ বললেন ডা. সরকার।
ক্লান্তিহীন রোবটিক হাত দীর্ঘ সময়ের অস্ত্রোপচারের জন্যও উপযোগী। বড় ও জটিল অপারেশনের ক্ষেত্রে টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা পরে চিকিৎসক ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তখন মাঝপথে অপারেশন থামিয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার তা শুরু করা হয়। ‘‘রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারি অনেকটা ভিডিয়ো গেম খেলার মতো। ১২ ঘণ্টার এই সার্জারির পরেও একজন সার্জন ক্লান্ত হবেন না তেমন,’’ বললেন ডা. সরকার।
মনে রাখতে হবে দক্ষতার বিষয়টিও। একজন সার্জনের হাতের দক্ষতা বয়সজনিত কারণে কমজোরি হয়ে যায়। কিন্তু রোবটিক হাতে বয়সের সীমাবদ্ধতা নেই, তার উপরে অটো-কারেকটেড। এর ফলে একজন বয়স্ক অভিজ্ঞ সার্জন রোবটিক হাত দিয়ে সার্জারি সম্পন্ন করতে পারবেন, যা শারীরিক ভাবে তাঁর পক্ষে করা হয়তো সম্ভব হত না।
আর একটি সুবিধে হল, অস্ত্রোপচারের পরে দ্রুত নিরাময় হয় এ ক্ষেত্রে। ওপেন সার্জারিতে শরীরের অনেকটা অংশ কাটতে হয়, সেই ক্ষত সারতে সময় লাগে। এই ধরনের সার্জারিতে ল্যাপরোস্কপির মতো ছোট ফুটো করে অপারেশন করা হয়। এতে ভিতরের টিসু ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এতে কাটাছেঁড়া নামমাত্র, রক্তপাত কম, যন্ত্রণা কম, ফলে অপারেশনের পরের সমস্যাগুলোও অনেক কম। হাসপাতালে থাকার মেয়াদ কমে, দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব হয়। ‘‘রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারিতে সূক্ষ অস্ত্রোপচারগুলি করা যায় সহজে এবং অনেক ঝুঁকিমুক্ত ভাবে। তাই বলা যায় ওপেন সার্জারির চেয়ে অনেকটা এবং ল্যাপরোস্কপির চেয়ে কিছুটা উন্নত রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারি,’’ পার্থক্যটা বুঝিয়ে বললেন ডা. সরকার।
যে সব অপারেশনের জন্য এই সার্জারি উপযুক্ত
এই অত্যাধুনিক পদ্ধতি মূত্রথলি, মূত্রাশয়, কিডনি, ইসোফেগাস, রেকটাম, গাইনোকলজিক্যাল ক্যানসারের মতো জটিল অপারেশনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোলজিতে ব্যবহার করা হচ্ছে এই পদ্ধতি। করা হয় অর্থোপেডিক সার্জারিও। ‘‘এখন নতুন রোবটিক যন্ত্রগুলিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে, যা বিষয়টি আরও উন্নত করেছে। সম্প্রতি ব্রেস্ট রিমুভাল সার্জারির জন্য রোবটিক আর্ম ব্যবহার করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে ব্রেস্ট রিমুভ করে সিলিকন ইনপুট দিয়ে স্তনের পুনর্গঠন করা সম্ভব হচ্ছে,” বললেন ডা. সরকার।
প্রতিবন্ধকতা
রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারি ভবিষ্যতে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে বিপ্লব আনতে চলেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে এই সার্জারির বড় প্রতিবন্ধকতা এর খরচ, বিশেষত ল্যাপরোস্কপি যেখানে কম খরচে হয়ে যায়। ‘‘এ দেশে প্রথম যখন এই প্রযুক্তি এসেছিল, তখন গলব্লাডার অপারেশনে শুধুমাত্র ইনস্ট্রুমেন্টের খরচ ছিল দেড় লক্ষ টাকা! কারণ বিদেশ থেকে আসত যন্ত্র। এখন ভারতে উন্নত মানের রোবট তৈরি হচ্ছে, ফলে দেড় লক্ষ টাকার খরচ তিরিশ-চল্লিশ হাজারে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। অনুমান করাই যায়, আগামী দু’-তিন বছরের মধ্যে রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারি বড় জায়গা করে নেবে এ দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে। এই দশকের শেষের দিকে রোবটিক অ্যাসিস্টেড সার্জারিই থাকবে, আর অন্যগুলি অল্টারনেটিভ সার্জারি হয়ে যাবে,’’ বললেন ড. সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy