সম্প্রতি হাওড়ার পাঁচজন নাবালকের রক্তে পাওয়া গিয়েছে ফাইলেরিয়াসিসের সন্ধান। এতে চিন্তা বেড়েছে সাধারণ জনগণ থেকে স্বাস্থ্য কর্তাদের। রাজ্য স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশে নেওয়া হয়েছে বিশেষ কর্মসূচি। এই প্রসঙ্গে মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সৌমিত্র ঘোষ বললেন, “এ দেশে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার, ছত্তীসগঢ়, উত্তরপ্রদেশ, কেরল ফাইলেরিয়ার এনডেমিক জ়োন। অনেক জায়গাতেই হয়, কিন্তু আন্ডার সাসপেক্ট থাকে। তাই সচেতনতা কম।” পৃথিবীব্যাপী তিন ধরনের ফাইলেরিয়াসিসের মধ্যে লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিসেই আক্রান্ত হতে দেখা যায় ভারতীয়দের।
রোগটি আসলে কী?
ফাইলেরিয়াসিস মশাবাহিত পরজীবীজনিত (কৃমি) অসুখ। স্ত্রী কিউলেক্স মশা ফাইলেরিয়াসিসের বাহক, এরা নোংরা জমা জলে জন্মায়। “এই মশা কোনও ফাইলেরিয়াসিস আক্রান্তকে কামড়ানোর পরে যদি অন্য সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখনই এই রোগ সংক্রমিত হয়। ঠিক যে ভাবে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি মশাবাহিত রোগ হয়। এর বাইরে অন্য কোনও ভাবে সংক্রমণ হতে পারে না,” বললেন ডা. ঘোষ। সংক্রমণের বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে প্যারাসাইটোলজিস্ট অমিতাভ নন্দী বললেন, “স্ত্রী কিউলেক্স মশার শরীরে পরজীবীর লার্ভা বা মাইক্রোফাইলেরিয়া যখন থার্ড স্টেজ লার্ভায় পরিণত হয়, তখন সেই মশা কাউকে কামড়ালে তাঁর শরীরে ফাইলেরিয়াসিস সংক্রমিত হয়। এই পরজীবী মানুষের শরীরে রক্তের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মূলত কুঁচকি, হাত, পা, অণ্ডকোষ, মহিলাদের স্তনের লিম্ফ নোড বা লসিকা গ্রন্থিতে বাসা বাঁধে। এর পরে একই সঙ্গে শরীরে থাকা স্ত্রী ও পুরুষ পরজীবীর মাধ্যমে বংশবিস্তার করে।” সঙ্গে একপ্রকার জলীয় পদার্থও নির্গত করে যা লসিকা নালি, লসিকা গ্রন্থি ও রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। এরই কারণে ফাইলেরিয়াসিস সংক্রমিত হলে জ্বর আসে, লসিকা গ্রন্থিতে প্রদাহ হয়।
রোগ বোঝার উপায়
জ্বর, শরীরে ব্যথা, মাথা ধরা, কুঁচকি, বগল, হাত-পায়ের কিছু অংশ লাল হয়ে ফুলে ওঠে। “এইগুলো আরও অনেক রোগের লক্ষণ। তাই প্রথমে জ্বর দেখেই ফাইলেরিয়াসিস শনাক্ত করা কঠিন,” বললেন, ডা. ঘোষ। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা রোগীর রক্ত পরীক্ষা করানোর আগে দেখে নেন, রোগী কোন অঞ্চল থেকে আসছেন এবং সেটা ফাইলেরিয়াপ্রবণ এলাকা কি না। রক্তে এই রোগের জীবাণু আছে কি না, তা জানার জন্য রাতে রক্তপরীক্ষা করতে বলা হয়। এর কারণ ব্যাখ্যা করলেন ডা. নন্দী, “শরীরের মধ্যে মাইক্রোফাইলেরিয়া দিনের বেলা বিভিন্ন গ্রন্থিতে লুকিয়ে থাকে এবং রাতে রক্তের মধ্যে চলাচল করে। এই জন্য রাতে কোনও ফাইলেরিয়া রোগীকে মশা কামড়ালে মশার শরীরে সেই জীবাণু প্রবেশ করে। আবার এই জন্যই রোগ নির্ধারণের জন্য রাতে রক্তপরীক্ষার কথা বলা হয়।”
চিকিৎসা
সাধারণত একবার আক্রান্ত হলে ফাইলেরিয়াসিস ঘুরেফিরে বারবার হবে। আক্রান্তের শরীরে সাত থেকে নয় বছর বেঁচে থাকে স্ত্রী পরজীবী। তত দিন বারবার রোগী আক্রান্ত হন। কত দিন পরপর তিনি আক্রান্ত হবেন, তাঁর জ্বর আসবে, প্রদাহ হবে বলা মুশকিল। সেরে যাওয়ার এক মাস পরেই হতে পারে আবার ছ’মাস বা এক বছর পরেও হতে পারে। “পূর্ণাঙ্গ পরজীবীকে দমন করার কোনও ওষুধ নেই। কিন্তু মাইক্রোফাইলেরিয়া দমনের জন্য ডায়াথালকার্বামাজ়িন ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধ এবং আনুষঙ্গিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগী অল্প কয়েক দিনের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। কিন্তু আবার যে কখন আক্রান্ত হবেন বলা মুশকিল,” বললেন ডা.নন্দী। বারবার অসুখ ফিরে আসার ফলে লসিকা গ্রন্থিগুলো ফুলে ওঠে। সেরে ওঠার পরেও কিছুটা ফোলা থেকে যায়। ক্রমে সেই জায়গার লসিকা নালিগুলো বুজে আসে, লসিকা চলাচল স্বাভাবিক হয় না। পরবর্তী পর্যায়ে সেই অঙ্গে ফাইব্রাস টিসু জমা হয়ে অঙ্গগুলি শক্ত হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে শক্ত থামের মতো হয়ে যায়, যাকে হাতি পা বা এলিফ্যান্টিয়াসিস বলে। এর ফলে রোগীর স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয় ও মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। সাত-আট বছর পর্যন্ত রোগী ফাইলেরিয়াসিস জীবাণু বহন করেন। কিন্তু তার পর শরীরে জীবাণু না থাকলেও অঙ্গ ফোলা সারাজীবন থেকে যায়।
সচেতনতা
ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গির মতো এই মশাবাহিত অসুখটি যে কোনও বয়সেই হতে পারে। এই রোগ সংক্রমণের একমাত্র কারণ মশা। তাই সাবধান হতে হবে মশা থেকে, বিশেষ করে রাতে। বাড়ির চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যাতে চারপাশে জল না জমে। রাতে ঘুমোনোর সময়ে মশারি ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে মশা মারার ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। জ্বর, সঙ্গে লাল হয়ে কোনও জায়গা ফুলে গেলে দেরি না করে ডাক্তার দেখাতে হবে। যদি জানা থাকে রোগী ফাইলেরিয়াপ্রবণ এলাকায় বসবাস করেন, তা হলে চিকিৎসককে সে কথা উল্লেখ করতে হবে।
ছবি: অমিত দাস, শুভদীপ সামন্ত
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)