Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
Mucositis

মিউকোসাইটিস থেকে উপশম

কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও বিভিন্ন সংক্রমণের কারণে মিউকোসাইটিস হতে পারে

কোয়েনা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:২৫
Share: Save:

স্টেজ থ্রি ক্যানসারে ভুগছেন অভিনেত্রী হিনা খান। কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মিউকোসাইটিসে আক্রান্ত হিনা। মূলত গলা, মুখের ভিতর, ঠোঁটে অসহনীয় ব্যথা তাঁর, গিলতে পারছেন না খাবারও। সমাজমাধ্যমে সম্প্রতি নিজেই এই সমস্যার কথা জানান অভিনেত্রী। চিকিৎসকেরা বলছেন, ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে।

সংক্রমণের কারণ

ডা. গৌতম মুখোপাধ্যায় বলছেন, “মিউকোসাইটিস হল মিউকাস ঝিল্লির প্রদাহ। মুখ থেকে অ্যানাস অবধি বিস্তৃত খাদ্যনালিতে থাকে মিউকাস ঝিল্লি। কেমোথেরাপির কারণে শরীরে ক্যানসার কোষের পাশাপাশি মুখের এবং হজমতন্ত্রের দ্রুত বিভাজনকারী কোষগুলোও নষ্ট হয়। ফলে দেখা দিতে পারে মিউকোসাইটিস। মুখ, গলা, পেট ইত্যাদি জায়গায় রেডিয়েশন থেরাপির কারণেও মিউকোসাইটিস হতে পারে।” তা ছাড়াও রয়েছে আরও নানা কারণ-

  • ভাইরাল সংক্রমণ: হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস, হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের মতো বিভিন্ন ভাইরাল সংক্রমণের কারণে মিউকোসাইটিস হতে পারে।
  • ব্যাক্টিরিয়াল সংক্রমণ: গলা, মুখে সিউডোমোনাস, স্ট্যাফাইলোকক্কাস বা স্ট্রেপটোকক্কাসের মতো ব্যাক্টিরিয়ার কারণেও মিউকোসাইটিস হয়।
  • ফাঙ্গাল সংক্রমণ: ক্যান্ডিডার মতো ফাঙ্গাসে মুখের মধ্যে মিউকোসাইটিস হতে পারে। কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশনের পর এই সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
  • অটোইমিউন রোগ: লুপাস বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো কিছু অটোইমিউন রোগ থেকেও মিউকোসাইটিস হতে পারে।
  • ট্রমা বা কেমিক্যাল এক্সপোজ়ার: মুখ, গলা বা শরীরের অন্য কোনও অংশে আঘাত মিউকোসাইটিস সৃষ্টি করতে পারে। তা ছাড়া, রাসায়নিক সংস্পর্শের কারণেও মুখ বা চোখে মিউকোসাইটিস সংক্রমণ হয়ে থাকে।
  • পুষ্টির ঘাটতি: ভিটামিন এ, বি১২ ইত্যাদির অভাবেও হয়।
  • অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া: খাবার বা পানীয় থেকে অ্যালার্জির কারণেও মিউকোসাইটিস হয়ে থাকে।

ধরন ও উপসর্গ

মিউকোসাইটিস বিভিন্ন ধরনের হয়। এর উপসর্গও আলাদা। এতে কখনও ব্যথা, প্রদাহ, কখনও আবার কেবল লাল ভাব দেখা দেয়। ডা. মুখোপাধ্যায় বলছেন, “উপসর্গ দেখে সাধারণত মিউকোসাইটিসের ধরন বোঝা সম্ভব। প্রয়োজনে পরীক্ষা করানো হয়।”

  • ওরাল মিউকোসাইটিস: মুখের ভিতরে, গাল, ঠোঁট, জিভ, মাড়িতে সংক্রমণ হয়। কিছু ক্ষেত্রে একে স্টোমাটাইটিসও বলা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে মুখে লালচে ভাব, ঘা, ব্যথা, কখনও আলসারের মতোও হয়।
  • গ্লোসাইটিস: জিভ ও জিভের উপরে এ ধরনের সংক্রমণে লালচে ভাব, ব্যথা, জ্বালা, ঘা ইত্যাদি হয়। এতে জিভ শুকিয়ে আসে, খাবার গিলতে, কথা বলতে সমস্যা হয়।
  • ডেন্টাল মিউকোসাইটিস: দাঁতের চারপাশে এবং মাড়িতে এ ধরনের সংক্রমণ হয়। ফলে মাড়ির প্রদাহ, ব্যথা, আলসার হতে পারে।
  • নাসোফ্যারিঞ্জিয়াল মিউকোসাইটিস: গলা, গলার পিছনে, নাক ও গলার সংযোগস্থল, ফ্যারিঙ্গসে হয়। এতে গলা ব্যথা, কাশি, নাক শুকিয়ে আসা, নাক থেকে রক্তপাত ইত্যাদি হতে পারে। খাবার তো বটেই, ঢোঁক গিলতেও যন্ত্রণা হয় রোগীর।
  • গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল মিউকোসাইটিস: খাদ্যনালি, অন্ত্র, পাকস্থলী ইত্যাদি স্থানে হয়। এর ফলে পেটে ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।
  • অ্যানাল মিউকোসাইটিস: মলত্যাগের সময়ে এতে ব্যথা, চুলকানি, রক্তপাত হতে পারে।

সমস্যা

মিউকোসাইটিসের ফলে ব্যথা, যন্ত্রণায় রোগী খেতে পারেন না। এতে অনেক সময়েই ওজন অতিরিক্ত কমে যায়। ফলে শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব হয়। এ ছাড়া, এর কারণে কখনও কখনও রোগীর কেমোথেরাপি কিংবা রেডিয়েশন থেরাপিও পিছিয়ে দিতে হয়। যন্ত্রণায় অনেকে চিকিৎসাও বন্ধ করিয়ে দেন। ফলে ক্যানসারের চিকিৎসায় প্রভাব পড়ে, রোগীর ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়ে।

কষ্ট কমাতে

ডা. সুবীর মন্ডল বলছেন, “ক্যানসারের চিকিৎসা চলাকালীন কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপির কারণে মিউকোসাইটিস হয়ে থাকে। এ ধরনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। তবে প্রথম থেকে সতর্ক হলে মিউকোসাইটিসের ঝুঁকি ও তীব্রতা কমানো যেতে পারে।”

  • খাদ্যাভ্যাসে বদল: নরম ও সহজপাচ্য খাবার যেমন- সুপ, স্মুদি, বা পুডিং ইত্যাদি খান। অত্যন্ত মশলাদার, টক, ঝাল, মিষ্টি বা গরম খাবার এড়িয়ে চলুন। ঠান্ডা খাবার বা পানীয় বেশি খান। খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- দই বা প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট ইত্যাদি।
  • ওরাল হাইজিনে নজর: মুখের স্বচ্ছতার দিকে খেয়াল রাখুন। দিনে দু’বার নরম ব্রাশ দিয়ে, প্রয়োজনে আঙুল দিয়ে দাঁত মাজুন। চা-কফি খেলেও মুখ ধুয়ে নিন। মেডিকেটেড মাউথওয়াশ ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • ক্রায়োথেরাপি: কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপির পূর্বে মুখে কয়েক কুচি বরফ রাখুন। কেমোথেরাপির সময়ে বরফ চুষলে মুখের মিউকোসাইটিসের ঝুঁকি কমে। কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশনের আগে প্যালিফার্মিন জাতীয় এক ধরনের ওষুধও দেওয়া হয়ে থাকে, যা মুখের মিউকাস ঝিল্লি রক্ষা করতে সাহায্য করে। তবে সব রোগীকে এ ধরনের ওষুধ দেওয়া যায় না।
  • হাইড্রেটেড থাকুন: খেয়াল রাখুন শরীর যেন শুষ্ক না হয়ে পড়ে। শরীরের প্রয়োজন মতো জলের চাহিদা মেটান। প্রচুর পরিমাণ জল খান। প্রয়োজনে ফলের রস, ডাবের জল ইত্যাদি খেতে পারেন। তবে অ্যালকোহল যুক্ত পানীয় একেবারেই এড়িয়ে চলুন। মুখ আর্দ্র রাখে এমন মিস্ট বা স্প্রেও ব্যবহার করতে পারেন।

চিকিৎসা

মিউকোসাইটিসের চিকিৎসা সাধারণত উপসর্গ অনুযায়ী করা হয়। ডা. গৌতম মুখোপাধ্যায় বলছেন, “ব্যথা কমাতে উপশমকারী ওষুধ দেওয়া হয়। সঙ্গে শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টির জোগান বজায় রাখতে নরম খাবার খাওয়া দরকার। প্রয়োজনে লিকুইড ডায়েটের পরামর্শ দেওয়া হয়। অবস্থা গুরুতর হলে আইভি ড্রিপ, রাইলস টিউব ইত্যাদি দেওয়া হয়।” মুখের ঘা থেকে উপশম পেতে চিকিৎসকেরা অনেক সময়ে কিছু জেল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। প্রয়োজনে অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করা হয়। লো লেভেল লেজ়ার থেরাপিও মিউকোসাইটিসের ব্যথা এবং প্রদাহ কমাতে কার্যকর।

মিউকোসাইটিসের চিকিৎসা সাধারণত রোগীর অবস্থা অনুসারে করা হয়। ক্যানসারের চিকিৎসা শেষ হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মিউকোসাইটিস সেরে যায়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা জরুরি।

অন্য বিষয়গুলি:

Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy