দেখলে হবে? খরচা আছে, আর চর্চাও আছে। তেমনই বলা যায়— সাজলে হবে? কষ্টও আছে। স্টিলেটোজ় জুতোজোড়া দেখতে যত দারুণ, পায়ে পরে চলতে মোটেও তত আরাম নেই। আর পুজোর ক’দিন যে প্রসাধনীগুলি ব্যবহার করলেন লাগাতার, তার কি কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই? খেয়াল করবেন, পুজোর সময়ে বা পরে, অনেকেরই ত্বকে দু’-একটা ব্রণ, লাল গোটা ওঠে। ত্বক একটু নির্জীবও লাগে। কেউ বা দেখেন চুলের জেল্লা কমে গিয়েছে যেন! এই যে ত্বকে পরত পরত ক্রিম মাখা হল, চোখে-ঠোঁটে-নখে নিত্যদিন রং পাল্টানো হল, চুলে পড়ল পার্মিং আর এক্সটেনশনের হিট আর হাইলাইটের কেমিক্যাল, এর থেকেই হয়তো ত্বক আর স্ক্যাল্পে সমস্যা হচ্ছে। অনেকে আয়ুর্বেদিক উপটান মাখিয়ে ত্বক আর চুলের বাড়তি যত্ন নিতে বলেন। অনেকে প্রসাধনী এড়িয়ে চলতে বলেন। কিন্তু তাতেই কি সমস্যা মিটবে? এই বাজারচলতি কসমেটিকস এবং সাধারণের পরিচিত বিউটি ট্রিটমেন্টগুলোয় কি সত্যিই ত্বক ও চুলের ক্ষতি হয়? অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে বিশদে আলোচনা করলেন ত্বকবিশেষজ্ঞ সন্দীপন ধর।
চেনা সমস্যা পিম্পল, অ্যালার্জি
পুজোয় বা তার পরেই অনেকের মুখে যে লাল ফুসকুড়ি, পিম্পল বার হয়, তার জন্য পরোক্ষে দায়ী প্রসাধনী। ডা. ধর বললেন, “পুজোর সময়ে হয় চড়চড়ে গরম, নয়তো বৃষ্টি। এই আর্দ্র গরমে ঠাকুর দেখতে বেরোলে ঘাম হয়, ত্বক তৈলাক্ত হয়ে যায়। প্রসাধনীর ঘন পরতের কারণে তৈল গ্রন্থি, ঘাম গ্রন্থি বন্ধ হয়ে যায়। গ্রন্থিগুলি থেকে বার হওয়া ঘাম, তেলও কসমেটিকসের পরতের মধ্যে আটকে যায়। ফলে পিম্পল হয়। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির নরম ক্লেনজ়ার দিয়ে মুখটা বারবার ধুলে পিম্পল হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। ফোমি ক্লেনজ়ার বাছলে তেল পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
সব ধরনের প্রসাধনীতেই কিছু রাসায়নিক থাকে, যেমন প্যারাবেন, ফর্মালডিহাইড, টিটানিয়াম ডাই অক্সাইড (সানস্ক্রিনেও থাকে), পলিইথেলিন গ্লাইকল। তার তালিকা প্যাকেজিংয়ে লেখা হয়। কিছু মানুষের অ্যালার্জির প্রবণতা বেশি থাকে। এগুলি থেকে তাঁদের অ্যালার্জি হতে পারে। অর্থাৎ সর্দি, কাশি, হাঁচি। সে ক্ষেত্রে অ্যান্টি-অ্যালার্জিক ওষুধ দেওয়া যায়। অ্যালার্জি, এগজ়িমা বার হলে সেগুলি চুলকালে রস বেরোতে পারে। এ ছাড়া অনেক সময় প্রসাধনী থেকে মুখে আমবাতের মতো ফুলে ফুলে যায়। প্রসাধনীর উপকরণ থেকে ত্বকে অস্বস্তি হলে কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিসও হতে পারে। প্যারাবেন থেকে খুবই কমসংখ্যক মানুষের অ্যালার্জি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও প্যারাবেনমুক্ত প্রসাধনী কিনতে পারেন।
লিউকোডার্মা বা শ্বেতি হলে, কোন রাসায়নিক থেকে এটি হল তা চিহ্নিত করে চিকিৎসা করতে হয়। স্টেরয়েড জাতীয় ক্রিম (মোমেটাসোন, ফ্লুটিকাসোন ইত্যাদি) লাগাতে হবে। ডা. ধরের সাবধানবাণী, “কোনও প্রসাধনী কিনে দুম করে সেটি ত্বকে ব্যবহার না করাই ভাল। আগে সেটি কানের পিছনে প্যাচ টেস্টিং করে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করুন। সমস্যা না হলে ওই প্রডাক্ট ব্যবহার করা নিরাপদ।”
হেয়ার রিমুভালের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
সবচেয়ে বেশি দেখা যায় যে, ওয়াক্সিং বা থ্রেডিংয়ের ফলে রোমের গোড়ায় ফুসকুড়ি হয়েছে। একে বলা হয় ফলিকুলাইটিস। ত্বকের উপরের ব্যাকটিরিয়া রোম তোলার পরে রোমকূপ দিয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। ফলে সংক্রমণ হতে পারে। এগুলি বেশ চুলকায়। তখন অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স করতে হয়। এর সঙ্গে অ্যান্টিব্যাক্টিরিয়াল ক্রিম লাগালে রেহাই মেলে। লেজ়ার ট্রিটমেন্টের হেয়ার রিমুভালে এ সমস্যা হয় না।
মুখের উপর কসমেটিক্সের প্রভাবের মতোই ওয়াক্সিং ক্রিম থেকেও অ্যালার্জি, এগজ়িমা, কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস হতে পারে। এ রকম কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে বরফ দিতে হবে। আবার খুব সংবেদনশীল ত্বকে হট ওয়াক্স থেকে ‘বার্ন’ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সে ক্ষেত্রেও স্টেরয়েড জাতীয় ক্রিম দিয়ে চিকিৎসা চলবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিউটিশিয়ান হেয়ার রিমুভালের পরে বরফ ও এই ধরনের ক্রিম লাগিয়ে দেন।
ডা. ধরের কথায়, “খেয়াল রাখবেন বিউটিশিয়ানরা যেন ডিসপোজ়েবল গ্লাভস পরে সব কাজ করেন। কারণ নখের রোগজীবাণু থেকেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে। প্রতিটি গ্রাহকের জন্য নতুন ও আলাদা গ্লাভস, চাদর, থ্রেডিংয়ের সুতো, তোয়ালে অপরিহার্য। গ্রাহক তাঁর চোখের সামনে নতুন সুতো, গ্লাভস, তোয়ালে বার করার ও ব্যবহার করার পর তা ফেলে দেওয়ার আবেদন জানাতে পারেন। এটি গ্রাহকের অধিকারের মধ্যে পড়ে। এতে গুরুতর সংক্রমণের আশঙ্কা কমবে।”
হেয়ার স্টাইলিং থেকে সমস্যা
গাছের কাণ্ডের মতো চুলেরও মূলত তিনটি ভাগ। কিউটিকল, হেয়ার কর্টেক্স ও মেডুলা। স্ট্রেটনিং, পার্মিং, কার্লিং, এক্সটেনশন ইত্যাদি হিট স্টাইলিং-এ চুলের কিউটিকল অংশের উপর চাপ তৈরি হয়। ঘন ঘন এমন স্টাইলিং হলে চুলের দণ্ডটা ভেঙে যাবে। অর্থাৎ চুল আঁচড়াতে গেলে চুলের এক একটি দণ্ড ভেঙে পড়বে। ডা. ধর বললেন, “প্রতি মাসে এমন ট্রিটমেন্ট করালে চুলের ক্ষতি হবেই। বিনোদন জগৎ, হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত হলে অন্য কথা। তখন তাঁদের স্টাইলিং করা চুলের বিশেষ যত্নের কথা ভাবতে হবে। এ রকম পেশাগত ক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজন না হলে বছরে দু’-তিন বার উৎসব, অনুষ্ঠানে এমন স্টাইলিং করুন।”
ঘন ঘন জেল, মুজ়, সেটিং স্প্রে, সেরাম ইত্যাদিতেও চুলের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। সবই কালেভদ্রে ব্যবহার করে শখ মেটানো ভাল। লাগাতার এ সবের ব্যবহারে চুল ওঠে, হেয়ার ফলিকলগুলি দুর্বল হয়ে যায়, অ্যালোপেশিয়া হয়, মাথায় টাক দেখা দেয়। ডা. ধর বললেন, “দু’টি লক্ষণ চুলের স্বাস্থ্যের অবনতি বুঝিয়ে দেয়। ইজ়ি ফ্র্যাজিলিটি আর ইজ়ি প্লাকেবিলিটি। চুল সহজে উঠে আসে, হাতে ধরলে ভেঙে যায়। পাটকাঠির মতো খরখরে চুল হয়ে যায়, হাতে নিলেই ভেঙে যায়। চিরুনিতে গোছা গোছা চুল লেগে থাকে। এ ক্ষেত্রে দ্রুত ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।”
সাবধানতার রাস্তা
ডা. ধর জানালেন, “নেলপলিশ থেকে চোখের পাতায় অ্যালার্জি হতে খুব দেখা যায়। হয়তো চোখের কাজল, আইলাইনারের কারণে অস্বস্তি হচ্ছে। সেই কারণে অজান্তে চোখে হাত চলে যাওয়ায় এই সমস্যা হয়েছে। সবই কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিসের উদাহরণ। অনেক ক্ষেত্রেই কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস রোগটির উৎসটিকে নির্ণয় করা মুশকিল হয়ে যায়। ডাক্তার লক্ষণ দেখে কারণটিকে চিহ্নিত করে রোগ নির্মূল করেন।”
ডা. ধর বললেন, এই ধরনের প্রডাক্ট বা ট্রিটমেন্ট থেকে ক্যানসারের ভয় অবশ্য নেই। তবে উটকো ঝামেলা হতেই পারে। প্রসাধনী থেকে কিছু সমস্যা হচ্ছে বলে, তা তো পুরোপুরি পরিহার করা যায় না। বরং প্রসাধনী, স্টাইলিং প্রডাক্ট ইত্যাদি কেনার সময় বা কোনও ট্রিটমেন্টের আগে প্যাকেজে লেখা উপকরণগুলো পড়ে নিন। আর প্যাচ টেস্টিং করুন। তাতে যে রাসায়নিকে সমস্যা হচ্ছে সেটি ধরা পড়বে, তখন যে প্রডাক্টে সেই উপকরণটি নেই তেমন প্রডাক্ট বাছতে হবে। বিদেশি কোম্পানিগুলি বাধ্যতামূলক ভাবে প্যাকেজে উপকরণগুলি পরিষ্কার করে লিখে দেয়, ক্ষতিকর রাসায়নিক নেই বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। এ দেশেও আইনকে এই বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে। যত দিন তা না হচ্ছে, নিজেদেরই সচেতন থাকা প্রয়োজন।
চিরশ্রী মজুমদার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy