মানবশরীরে নার্ভাস সিস্টেম বা স্নায়ুতন্ত্রকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র। অন্যটা, পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেম বা প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্র। এই প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্রের একটি অসুখ হল গিলন বেরি সিনড্রোম (জি বি সিনড্রোম)। কিছু ইমিউনোলজিক্যাল প্রতিক্রিয়ার কারণে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই অসুখ হয়ে থাকে। নিউরোলজিস্ট জয়ন্ত রায় জানালেন, বিশেষ কিছু ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়ার সংক্রমণের কারণে অস্থায়ী ভাবে শরীরের ইমিউন সিস্টেম বদলে যেতে পারে। সংক্রমণের কারণে এমন কিছু অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যেগুলি আমাদের প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন স্নায়ু আক্রমণ করে সেগুলির ক্ষতি করতে শুরু করে। অ্যান্টিবডিগুলি কখন এবং কেন তৈরি হয়, তা চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। তবে এখনও পর্যন্ত কিছু সংক্রমণকে চিহ্নিত করা গিয়েছে, যারা গিলন বেরি সিনড্রোমের সূচনা করতে পারে। যেহেতু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ইমিউন সিস্টেমের বদল হতে কিছু দিন সময় লাগে, তাই সংক্রমণের পরেই কিন্তু এই অসুখে কাবু হয় না রোগী। এই সূত্রে ডা. রায় বললেন, চোখ থেকে পায়ের যে কোনও স্নায়ুই পড়তে পারে এই রোগের কবলে।
লক্ষণ
একেবারে সদ্যোজাত শিশু ছাড়া পুরুষ নারী নির্বিশেষে যে কোনও বয়সেই জি বি সিনড্রোম হতে পারে। এই অসুখের নানা ধরন থাকে। জি বি সিনড্রোমে সাধারণত হাত এবং পায়ে প্যারালিসিস হয়। ডা. রায় জানালেন, রোগীদের অনেকেরই রোগটি কোমরে ব্যথা দিয়ে শুরু হয়। সেই সঙ্গে হাত-পা ঝিনঝিন করতে থাকে। এর পরে ঠিকমতো পা ফেলে হাঁটা বা হাত নাড়ানোর অসুবিধে দেখা দেয়। এর এক দিন পরেই দেখা গেল যে, সেই ব্যক্তি বসলে উঠতে পারছেন না, হাতে ঠিকমতো ভর দিতে পারছেন না। এ ভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে এক সময় ব্যক্তির হাত-পা— দুটোই প্যারালাইজ়ড হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণগুলি খুব তাড়াতাড়ি, হয়তো এক দিনের মধ্যে পরিলক্ষিত হতে পারে। আর কিছু ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে, এক মাস ধরেও হতে পারে। এই অসুখের তীব্রতা এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হতে দেখা যায়। কারও ক্ষেত্রে অসুখটি এত হাল্কা মাত্রায় হতে পারে যে সাময়িক ভাবে কিছু অসুবিধে দেখা দিলেও, কিছু দিন পরে তাঁরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন। কিন্তু কারও ক্ষেত্রে এই তীব্রতা এত বেশি হয় যে, হাত-পায়ে প্যারালিসিসের পাশাপাশি তাঁদের রেসপিরেটরি প্যারালিসিস-ও হতে পারে। তখন বাঁচানোর রোগীকে ভেন্টিলেশনে দিতে হয় বলে জানালেন ডা. রায়।
যাঁদের অসুখটি ধীরে ধীরে হতে থাকে, তাঁদের ক্ষেত্রে বাড়ির লোকজন সাধারণত এটিকে কোনও অসুখের লক্ষণ হিসেবে ধরতে পারেন না। কিছু দিনের মধ্যেই বা দ্রুতই যখন লক্ষণগুলি অস্বাভাবিক ঠেকতে শুরু করে, তখন তাঁরা দ্বারস্থ হন চিকিৎসকের। ডা. রায় বললেন, অসুখের প্রথম সাত দিনের মধ্যে গিলন বেরি সিনড্রোম নির্ণয় করা বেশ মুশকিল। কারণ তখন কোনও পরীক্ষায় এই রোগ ধরা পড়ে না। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের রোগ নির্ণয়ের জন্য ক্লিনিকাল অ্যাসেসমেন্টের সাহায্য নিতে হয়। মাঝেমধ্যেই, প্রয়োজনে এক দু’দিন অন্তর রোগীকে দেখতে হতে পারে। যদি দেখা যায় যে কিছু সময় অন্তরই নতুন নতুন উপসর্গ (হাত পা ঝিমঝিমের পরে উঠতে বসতে অসুবিধে, কয়েক দিন পরে হাতের সাড় চলে যাওয়া ইত্যাদি) দেখা যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের নির্ণয় করতে সুবিধে হয় যে রোগী জি বি সিনড্রোম-এ ভুগছেন। সে ক্ষেত্রে অবিলম্বে চিকিৎসা শুরু করে দিতে হয়। ডা. রায় এও বললেন যে অনেক জি বি সিনড্রোমের ধরনে রোগীর হাত, পায়ের প্যারালিসিস-এর বদলে অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়। কারও হয়তো চোখের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে চোখ ট্যারা হয়ে যেতে পারে। কারও মুখের স্নায়ুর সমস্যা দেখা যায়, যার ফলে তিনি গাল ফোলাতে, চোখের পাতা বন্ধ করতে কিংবা কাশতে বা ঢোঁক গিলতে পারেন না।
মনে রাখতে হবে, জি বি সিনড্রোমের তীব্রতা নির্ভর করে স্নায়ু কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার উপরে। এই প্রসঙ্গে ডা. রায় জানালেন, যে কোনও স্নায়ুর দুটো অংশ থাকে— এক, স্নায়ুর কেন্দ্রস্থল যাকে অ্যাক্সন বলা হয় আর দুই, তার বাইরের আস্তরণ যাকে বলা হয় মায়লিন। অ্যাক্সন হল স্নায়ু কোষের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যাঁদের শরীরে অ্যাক্সন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাঁদেরপেশির দুর্বলতা হয় খুব বেশি। আর, জি বি সিনড্রোমের তীব্রতাওবেশি দেখা যায় এ ক্ষেত্রে। অ্যাক্সনের ক্ষত সারতেও বহু দিন সময়লাগে। তাঁদের ভেন্টিলেশনেও থাকতে হয় বহু দিন। অন্য দিকে, মায়লিন-এর ক্ষত সারতে বেশি সময় লাগে না।
চিকিৎসা
ক্লিনিকাল এগজ়ামিনেশনের বাইরে দু’টি পরীক্ষা চিকিৎসকেরা করে থাকেন জি বি সিনড্রোম-এর ক্ষেত্রে। এক, নার্ভ কনডাকশন স্টাডি আর অন্যটি সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুয়িড স্টাডি বা লাম্বার পাংচার। ডা. রায় জানালেন, অসুখের প্রথম সপ্তাহে দুটোর রিপোর্টই কিন্তু নর্মাল আসতে পারে। তাই ক্লিনিকাল এগজ়ামিনেশনের সূত্র ধরে চিকিৎসকদের এই দু’টি পরীক্ষা দেখতে হয়। তবেই রোগটিকে ঠিক সময়ে নির্ণয় ও চিকিৎসা করা যায়। জনমানসে এই বিষয়ে সচেতনতা বা রোগের পরিচিতি না থাকায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়।
সারা বিশ্বে জি বি সিনড্রোমের সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা হল দু’টি। এক, ইনট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবিউলিন। তারএকটা পাঁচ দিনের কোর্স থাকে।ডা. রায় জানালেন, ওষুধটা বেশ দামি। এ ক্ষেত্রে নতুন অ্যান্টিবডি শরীরে ঢুকিয়ে খারাপ অ্যান্টিবডিগুলিকে দমন করার চেষ্টা করা হয়।
অন্য চিকিৎসাটির নাম প্লাজ়মাফেরেসিস। এ ক্ষেত্রে ওষুধ দেওয়ার বদলে ডায়ালিসিস-এর মতো করে রোগীর শরীর থেকে রক্ত ফিল্টার করে খারাপ অ্যান্টিবডিগুলিকে শরীর থেকে সরানোর চেষ্টা করেন চিকিৎসকেরা। আর যে ক্ষতিটা ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে, সেটা সারার জন্য অপেক্ষা করেন। কারণ স্নায়ু নিজেকে সারিয়ে নিতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরে সেটাকে সারতে দেওয়ার সময় দিতে হয়।
ডা. রায়ের দাবি, ঠিক সময়ে রোগনির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে জি বি সিনড্রোম পুরোপুরি সারানো সম্ভব, এমনকি খুব বেশি মাত্রায় আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রেও। এই রোগে মস্তিষ্কের কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু শরীরের বাকি অঙ্গ অসাড় হয়ে যাওয়ার ফলে এটি রোগীর কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। সজ্ঞান অবস্থায় ভেন্টিলেশনে থাকার কারণে তা মানসিক ভাবে আরও দুর্বল করে দেয় রোগীকে। তাই এ সময়ে তাঁকে মানসিক ভাবে চাঙ্গা রাখতে হয়। প্রতিনিয়ত বোঝাতে হয়, সময়ের সঙ্গে তিনি ঠিকই ভাল হয়ে উঠবেন।
ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়ে আসার পরে এই ধরনের রোগীদের রিহ্যাবিলিটেশনের প্রয়োজন পড়ে। স্নায়ু ঠিক হতে যত বেশি সময় লাগে, তত বেশি তার প্রভাব পড়ে পেশি এবং জয়েন্টের উপরে। সেগুলিকে যদি ঠিকমতো পুনরুজ্জীবিত না করা যায়, তা হলে দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক অক্ষমতা দেখা দিতে পারে। এই জন্যই ভেন্টিলেশন থেকে বেরোনোর পরে রোগীকে প্রয়োজন অনুযায়ী ফিজ়িয়োথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি (কেউ আইটি প্রফেশনাল, অসুখের পরে তাঁর হয়তো আঙুল নাড়াতে সমস্যা হচ্ছে, সেই সমস্যা মেটাবেন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট), সোয়ালো থেরাপি (যার ঢোঁক গিলতে সমস্যা হচ্ছে) বা স্পিচ থেরাপি (কথার সমস্যা হচ্ছে)-র পাশাপাশি সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং করতে হতে পারে।
পরিশেষে, ডা. রায়ের পরামর্শ, এই রোগে ভীত বা হতাশাগ্রস্ত হওয়া মোটেই উচিত নয়। ঠিক সময়ে রোগনির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসায় রোগটিকে পুরোপুরি সারিয়ে তোলা যায়। তাই মনের জোর এবং ধৈর্যএই রোগ থেকে সেরে ওঠার অন্যতম দুই হাতিয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy