প্রতীকী ছবি।
২৬ ডিসেম্বর, সোমবার
সকাল সকাল বিনোদন বিভাগের সম্পিতার হোয়াটস্অ্যাপ, ‘‘পৃথাদি, কাল অফিস যাওয়ার সময় শরীর আরও খারাপ হয়েছে। মেট্রো স্টেশন থেকে বেরোতে পারছিলাম না। মাথা ঘুরছিল। সৈকত আর শ্রুতি অফিস অবধি পৌঁছে দিল। আমি কয়েক দিন কি বাড়ি থেকে কাজ করতে পারি?’’ সম্পিতার তিন-চার দিন থেকেই জ্বর। ভাইরাল ফিভার এক বার হলে সাত দিন জ্বালায় বলেই জানা। তাই অনুমতি দিয়েছিলাম।
দুপুরে টিমের আরও এক সদস্য দেবদত্তা নাক টানতে টানতে ঢুকল। আলুথালু চুল। সারা ক্ষণ বকবক করা মেয়েরও করুণ অবস্থা! জানাল, প্রচণ্ড ঠান্ডা লেগেছে, শরীর খুব খারাপ। এ দিকে জীবনধারা বিভাগের সুচন্দ্রাও কোনও রকমে অফিস এসেই ঝিমিয়ে গেল। তারও বেশ কয়েক দিন ধরেই জ্বর। দিনের কাজ গুটিয়ে অফিস থেকে ফেরার সময়ই লক্ষ করলাম, চোখ থেকে সমানে জল পড়ছে। মাথাটাও কেমন ভারী লাগছে। পাত্তা না দিয়ে মন দিলাম একেনবাবুর নতুন সিজ়নে। শুক্রবার ‘কী দেখবেন, কেন দেখবেন’-এ রিভিউ করতে হবে যে!
২৭ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার
রোজকার মতোই ভোর সাড়ে ৫টায় অ্যালার্ম বাজল। কিন্তু বুঝতেই অনেকটা সময় লাগল, কী হচ্ছে! রাতে ভাল ঘুম হয়নি। শরীরটা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছিল। আর সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। সকালে ঠিক হয়ে যাবে ভেবে কোনও ওষুধ না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই বুঝলাম ভুল করেছিলাম।
সকাল ৬টা ৫-এ সম্পাদক অনিন্দ্য জানাকে বাধ্য হয়ে হোয়াটস্অ্যাপ করে একটি সিক লিভের আবেদন জানালাম। উত্তর আসার আগেই অজান্তে ফের ঘুমিয়ে পড়লাম। আবার যখন ঘণ্টাদেড়েক পর ঘুম ভাঙল দেখলাম, অনিন্দ্য’দা অনুমতি দিয়েছেন। তখন টিমের বাকিদেরও জানালাম। দু’-তিনটে নির্দেশ দিলাম কী কী করণীয়। মাথায় চিন্তা ঘুরছে বছর শেষের স্পেশ্যাল স্টোরি নিয়ে। কিন্তু ভাবতেই ভাবতেই আবার ঘুম চলে এল চোখে।
সকাল ১০টা নাগাদ মা এসে ঘুম ভাঙাল। গায়ে যে ভালই জ্বর টের পেলাম। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ঙ্কর মাথায় যন্ত্রণা। মা বলল, জলখাবার খেতেই হবে। না হলে ওষুধ দেওয়া যাবে না। তাই কোনও রকমে খেয়ে (শুকনো মুড়ি খেতে পারি না, তাই মা আলুর তরকারির সঙ্গে মুড়ি দিয়েছিল) ‘প্যারাসেফ ৬৫০’ খেয়ে নিলাম। ঘুমিয়ে পড়লাম আবার।
দুপুর ৩টে নাগাদ উঠে দেখি সহকর্মীদের গুচ্ছের ফোন আর হোয়াটস্অ্যাপ। স্বাভাবিক ভাবেই বছর শেষে কাজের চাপ বেশি থাকে। স্পেশ্যাল স্টোরি নিয়ে তাঁদের নানা রকম প্রশ্ন থাকাই স্বাভাবিক। আমি চেষ্টা করলাম, যতটা পারি সকলকে একে একে উত্তর দেওয়ার। কিন্তু পাঁচ-সাত মিনিট যেতে না যেতেই দেখলাম স্ক্রিনের দিকে আর তাকাতে পারছি না। মাথা ব্যথায় দপদপ করছে। আবার ফোন রেখে ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু এ বার আর ঘুম এল না। মাথাব্যথা যেন বেড়েই যাচ্ছে। শুয়ে শুয়ে এ পাশ-ও পাশ করতেও অসুবিধা হচ্ছে। কারণ শরীরে খুব ব্যথা!
সন্ধের আগে আগে চোখ লেগে গিয়েছিল। মা আদা-চা দেওয়ার জন্য ঘরে আসায় ঘুম ভাঙল। অভ্যাসের বশে ফোনে চোখ যেতেই সোজা হয়ে উঠে বসলাম। প্রধান সম্পাদক অভীক সরকারের মিস্ড কল আর অনেক হোয়াটস্অ্যাপ মেসেজ। সকালের একটি স্পেশ্যাল স্টোরির লেআউট পছন্দ হয়নি তাঁর। নিজেই ফোন করে বাকি বকুনিটা খেয়ে নিলাম। পাশাপাশি, অনিন্দ্য’দাও একই মেসেজ ফরওয়ার্ড করেছেন দেখলাম। মাথা-কপাল-চোখে এমন ব্যথা করছে যে, কোনও রকমে ফোনের দিকে তাকাচ্ছি। আদা-চায়ে চুমুক দেওয়ার আগেই অনিন্দ্য’দাকে ফোন করলাম। একটা স্টোরি বাতিল, পরের দিনেরটা কী হবে? এতগুলো স্টোরির লাইন আপ, সেগুলো শেষ মুহূর্তে যদি বদলায়, আমি অফিস না গেলে তা কী করে সম্ভব? দেওয়ালে পিঠ থেকে গেলে একমাত্র অনিন্দ্য’দাই ভরসা। ফোন করলাম। কথা হল। আমার মিনমিনে গলার স্বর শুনে বোধহয় অনিন্দ্য’দার মায়া হল। বললেন, ‘‘এটা নিয়ে এখন ভাবিস না। কাল দেখা যাবে।’’
জ্বর আসছে বুঝতে পারছিলাম। পাতলা মাছের ঝোল আর ভাত খেয়ে আবার ‘প্যারাসেফ ৬৫০’। তত ক্ষণে বাড়ির লোক ডাক্তার দেখানোর কথা গুনগুন করে গাইতে শুরু করেছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না, তা-ও যতটা পারি জোর দিয়ে বললাম, ‘‘ধুর! সবার ভাইরাল হচ্ছে এমনিই ঠিক হয়ে যাবে।’’
রাতে শুতে যাওয়ার আগে আবার অনিন্দ্য’দা এবং বার্তা সম্পাদক মুকুল দাসের সঙ্গে কনফারেন্স কল। কী করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা। মশারির মধ্যে শুয়ে আমি নির্দেশ শুনছি কোনও রকমে। অনিন্দ্য’দা বললেন, ‘‘আমি অভীকবাবুকে জানিয়েছি তোর খুব শরীর খারাপ। তুই কাল অফিস না-ও আসতে পারিস। উনি লিখেছেন, ‘ওহ্ আই অ্যাম সো সরি’। দাঁড়া এ বার আমায় ফোন করছেন।’’
কল আচমকা শেষ। কম্বলের নীচে তখন চোখ বুজে আসছে। কিন্তু মনে মনে ভাবছি, অনিন্দ্যদা কী জানাবে শেষ পর্যন্ত। জেগেই থাকি। কিছু ক্ষণ পরেই ফোন। অনিন্দ্য’দা ভরসা দিলেন, পর দিন উনি পুরোটা সামলে নেবেন। আমি যেন নিশ্চিন্তে থাকি। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।
২৮ ডিসেম্বর, বুধবার
রাতে বারে বারে ঘুম ভেঙেছে। গায়ে ব্যথা সকালে একটু কমলেও মাথা যন্ত্রণা তীব্র। মনে মনে আমি ক্যালকুলেশন করছি। আজ বাড়িতে থেকে বিশ্রাম নিয়ে ঠিক হতেই হবে। না হলে চলবে না। পর দিন সুচন্দ্রার ছুটি। আমি কাজে না বসলে কপি দেখার লোক কম পড়বে। এ সব ভাবতে ভাবতে অনিন্দ্য’দাকে মেসেজ পাঠিয়ে অনুমতি চাইলাম। সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এল, ‘শিওর’। আগের দিন অনিন্দ্য’দাও এক বার জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছি কি না। দু’দিন পর পর অফিস যাচ্ছি না দেখে বাড়ির লোকও বেশ চিন্তিত। পাড়ার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য এ বার জোরাজুরিটা বেশি হল। অগত্যা সকাল সাড়ে ১০টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হল। ১১টায় আমার বিনোদন বিভাগের মিটিং। ভার্চুয়ালি থাকার কথা আমার। খালি ভাবছি, তার মধ্যে সব মিটে যাবে কি না। চেম্বারে বেশ কয়েক জন রোগী। বেশির ভাগই এসেছেন জ্বর নিয়ে। এক জন এসেছেন কাশি কমছে না বলে। ১০টা ৪৭-এ আমায় ডাকলেন চিকিৎসক বাসব চট্টোপাধ্যায়।
‘‘কী হল রে তোর আবার?’’
‘‘তেমন কিছু না, শুধু একটু জ্বর। কিন্তু খুব মাথাব্যথা। একটা ওষুধ লিখে দিন তো।’’ মা পাশ থেকে, ‘‘না না, ডাক্তারবাবু, ঠিক করে দেখুন। দু’দিন কাজে যায়নি। অনেক সময় রাতে মশারি টাঙায় না। ডেঙ্গি-ফেঙ্গি বাঁধাল কি না কে জানে!’’
‘‘এ দিকে আয়। বড় করে শ্বাস নে।’’ (বয়স্ক চিকিৎসক। তাই এখনকার চিকিৎসকের মতো টেস্ট না করিয়ে রোগী দেখবেন না জাতীয় ছুঁতমার্গ নেই। এখনও স্টেথোস্কোপ দিয়ে প্রথমেই বুক, পিঠ দেখেন। জিভ বার করতে বলেন। চোখের আলো ফেলে দেখেন।)
‘‘ঠান্ডা লাগিয়েছিস নাকি?’’
‘‘আমার টিমে অনেকের জ্বর। ওখান থেকেই হয়েছে মনে হচ্ছে।’’
‘‘টেস্ট লিখব নাকি?’’ (মুখ টিপে হেসে তত ক্ষণে তিনি প্রেসক্রিপশনে খসখস করে লেখা শুরু করে দিয়েছেন।)
‘‘আপনি লিখতেই পারেন, আমি করাব না।’’ (ছোট থেকে চেনা। তাই বলার জোর রয়েছে।)
‘‘সে আর জানি না? মাথাব্যথা ছাড়া আর কী কী সমস্যা হচ্ছে বল।’’
‘‘গায়ে-হাত-পায়ে ব্যথা। খুব উইক লাগছে। আর চোখ দিয়ে জল পড়ছে মাঝেমাঝে। তবে সর্দি-কাশি তেমন নেই।’’
‘‘টেম্পারেচার কত আসছে?’’
‘‘ওই ১০০-র একটু উপরে। এক বার ১০১ ছাড়িয়েছিল।’’
‘‘অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছি না। প্যারাসিটামল দিলাম। ব্যথার ওষুধ দিচ্ছি। কিন্তু তুই একটা ভিটামিন ডি-র কোর্স কর। আর ঠিক করে খাওয়াদাওয়া কর। সারা দিন ঠিক করে জল খাস বলে তো মনে হয় না।
‘‘না না, ওর ও সবের বালাই নেই।’’ (পাশ থেকে মা বলে উঠল।)
ঘড়িতে ১১টা বেজে গিয়েছে। মিটিং শুরু হবে। আমি উঠব। মা আবার বলে উঠল, ‘‘ডাক্তারবাবু, ডেঙ্গির ভয় নেই তো? ঘরে তো খুব মশা!’’
‘‘ডেঙ্গি হলে জানান দিত। ওর সিম্পটম সবই ভাইরালের। চিন্তা করবেন না। সবাই আমার কাছে এই একই জিনিস নিয়ে দু’বেলা আসছে। কারও কারও আবার খুব কাশি। অবস্থা বুঝে অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছি। ওর এখনই দরকার নেই। একটু বেশি করে প্রোটিন খাওয়ান। চিকেন স্টু দিলে ভাল হয়। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে এক বার নক করবেন।’’
আমি তত ক্ষণে ফোনে ইয়ারফোন গুঁজে ওষুধের দোকানে ওষুধ কিনছি। প্যারাসিটামল, লুমিয়া (ভিটামিন ডি), সেট্রিজিন ছাড়াও দেখলাম আইবুপ্রোফেন দিয়েছেন। ব্যথার ওষুধ ওটাই। সবার আগে ওটা চাইলাম।
২৯ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার
সকালবেলা উঠে তাড়াতাড়ি অফিসের জন্য বেরিয়েছি। ভাবলাম, মেট্রোর ভিড় এড়াতে একটু আগেই বেরোনো ভাল। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়েই টের পেলাম শরীর কত দুর্বল। অফিসে পৌঁছতেই সহকর্মীরা এক এক করে এসে এই শরীরে কাজে আসার জন্য নিন্দে করে গেল। সারা দিন চেয়ারে বসে কপি দেখতেও অসুবিধা হচ্ছিল। বার বার মাথাব্যথাটা কপির ফাঁকেও ধাক্কা মারছিল।
বাড়ি ফিরে ওষুধ আর আদা-চা খেয়ে ঘুম দিলাম। বাড়ির লোক বিধাননগর মেলায় গিয়েছিল। রাতে ফিরে আমায় ডেকে কী কী কেনাকাটা করেছে দেখাল। সে সব দেখে শরীর আরও একটু চাঙ্গা হল বইকি! কয়েকটা কপি দেখলাম ফোন থেকেই। খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুম।
৩০ ডিসেম্বর, শুক্রবার
সকালে উঠে বুঝলাম, মাথাব্যথা কমেছে। তবে শরীরে ব্যথা বলে ঠান্ডায় আরও কষ্ট হচ্ছে। আজ আবার ‘কী দেখবেন, কেন দেখবেন’-এর এপিসোড শুট করতে হবে। তাই ভাল দেখে একটা জামা পরে বেরিয়ে পড়লাম। অফিস যখন পৌঁছেছি, তখন পেলের মৃত্যু, মোদীর মায়ের শেষকৃত্য আর ঋষভ পন্থের গাড়ি দুর্ঘটনা নিয়ে অনুজ সহকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছে। নতুন উদ্যমে যাকে যা নির্দেশ দেওয়ার দিয়ে, কপি দেখতে বসলাম। দেখলাম আজ অনেক বেশি টানতে পারছি। বুঝলাম, ওষুধের চেয়েও ভাইরাস বেশি কাবু হয় কাজের চাপে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy